বিশ্বে প্রতিদিন যক্ষ্মা, এইডস বা ম্যালেরিয়ায় যত লোক মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি লোক মারা যায় ধূমপানের কারণে। খোদ আমেরিকাতেই প্রতিদিন ১,৪০০ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে ধূমপানের কারণে।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ তার ‘দ্য ওয়ে টু সেভ মিলিয়নস অফ লাইভস্ ইজ টু প্রিভেন্ট স্মোকিং’ গ্রন্থে বলেন, আমরা যদি এখনই কোনো পদক্ষেপ না নিই তাহলে এ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে গিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১ বিলিয়নে। ২০০২ সালে মার্কিন সিনেটে কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করা হয়। এটি সাধারণ মানুষের কাছে যেমন প্রশংসিত হয়েছে তেমনি রেস্টুরেন্টগুলোতেও বেড়ে গেছে বিক্রি।
এর কিছুদিন পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি এবং আয়ারল্যান্ডেও একই আইন প্রণয়ন করা হয়। সিগারেটের ওপর আরোপ করা হয় উচ্চহারের ট্যাক্স। ধূমপানবিরোধী প্রচারণা পায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। এ সবকিছুর ফলে এখন সেখানে ধূমপানের হার কমে গেছে ২১%। কিশোর ধূমপায়ীর সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ চিত্রটা এত সুখকর নয়। বলা হয়, আগামী কয়েক দশকে ধূমপানজনিত কারণে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটবে উন্নয়নশীল দেশে। আমাদের দেশে ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রথম সফল উদ্যোগ নেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম। তার উদ্যোগেই গড়ে ওঠে ‘আধূনিক’ (আমরা ধূমপান নিবারণ করি)-ধূমপানবিরোধী জাতীয় প্রতিষ্ঠান। অবশ্য তার আগে তিনি নিজে ধূমপান ছাড়েন। কলেজে পড়ার সময় থেকে ধূমপানে অভ্যস্ত হন তিনি। পরবর্তী ২০ বছরে সিগারেট ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্রোতে’ বইয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ধূমপানের অভ্যাস ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে এল যখন সিগারেট পেতে কোনো সংকটের সম্ভাবনা থাকলে আগে থেকে কিনে এনে জমা করে রাখতাম। মনে হতো ধূমপান ছাড়া পড়াশোনা অসম্ভব। তাই বিলেতে থাকাকালীন শীতের সময় সিগারেট শেষ হয়ে গেলে বরফের মধ্যে যদি বেরুতে না পারি, এ আশঙ্কায় অনেকগুলো সিগারেট একসাথে কিনে আলমারিতে রেখে দিতাম।
জেনেশুনেও আমি ধূমপান করতাম। ক্লাসে, ওয়ার্ডে যেখানে যাই না কেন, সবসময় হাতে একটা সিগারেট থাকত। ধূমপান করতে করতে ঠোঁটে এবং আঙুলে দাগ পড়ে গিয়েছিল। এটাকে লজ্জার নয়, সামর্থ্যের লক্ষণ ধরে নিতাম। শুধু নিয়ম লঙ্ঘন নয়, আমি যেন একটা ঘৃণ্য উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতাম।
একটা সময় ধূমপান ত্যাগের ইচ্ছা করলাম। এজন্যে অবলম্বন করলাম নানা উপায়। প্রথমে একটা সিগারেট কেটে দুভাগ করে খেতে লাগলাম। এতে কাজ হলো না। তারপর সকালে শপথ নিলাম যে, দুপুর পর্যন্ত ধূমপান করব না। কিন্তু যেই সময় শেষ, অমনি একটার পর একটা খেতে থাকি। সারাদিনের বরাদ্দ ২/৩ ঘণ্টায় শেষ! প্রতিদিন মনস্থ করি পরদিন থেকে আর ধূমপান করব না। কিন্তু সেদিন আর আসে না। এভাবে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটতে থাকে।
একদিন সকালে নামাজ সেরে আল্লাহর নাম নিয়ে পর পর তিনবার শপথ নিলাম সিগারেট আমার জন্যে হারাম, জীবনেও আর ধূমপান করব না। এবার চরম পরীক্ষা। একদিকে আল্লাহর নাম নিয়ে প্রতিজ্ঞা, অন্যদিকে নেশার টান। শেষ পর্যন্ত বিবেক আর ধর্মবিশ্বাসই জয়ী হলো।
১৯৬৩ সালের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত ধূমপান করি নি। চিকিৎসক হিসেবে এ মারাত্মক অভ্যাস থেকে অনেককেই বিরত করতে সক্ষম হয়েছি। এদের মধ্যে আছেন সাবেক স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনবিশারদ সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, চিত্রাভিনেতা এবং চিত্রপরিচালক খান আতাউর রহমান। পিজি থেকে অবসর গ্রহণের আগে ‘এ’ ব্লকের দক্ষিণ দিকের দেয়ালে বড় বড় হরফে ‘ধূমপানে বিষপান’ শব্দ দুটো লোহার পাতে লিখে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বিগত দুযুগ ধরে যাদের ধূমপান বন্ধ করতে বার বার বলে এসেছি অথচ আমার উপদেশ গ্রহণ করেন নি, তাদের কেউ এখন ক্যান্সারে, কেউ হৃদরোগে, কেউ প্যারালাইসিসে, কেউ ক্রনিক ব্রংকাইটিস বা শ্বাসকষ্টে, কেউবা পায়ে গ্যাংগ্রিন বা পচনরোগে ভুগছেন দেখে ব্যথা পাই। ধূমপানে বিষপান—এটা এখন একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় এর বিসর্জন।