ভেপ (Vape)- ধূমপানের এক আধুনিক ভার্সন, যার সেবন মাধ্যম হলো ইলেক্ট্রনিক সিগারেট বা সংক্ষেপে ই-সিগারেট। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে এদেশের তরুণ-যুবাদের হাতেও।
প্রথমদিকে যখন ই-সিগারেট বাজারজাত হয়, তখন বলা হয়েছিলো এটি ধুমপানের কম ক্ষতিকর বিকল্প; কাজেই যারা ধূমপান ছেড়ে দিতে চান তাদের জন্য ই-সিগারেট আদর্শ! চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই হাল ফ্যাশন হিসেবে ই-সিগারেটের দিকে ঝুঁকতে থাকে। এতে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই তারা হয়ে পড়ে আসক্ত।
ই-সিগারেট আসলে একটি ডিভাইস যাতে আছে অ্যাটোমাইজার, একটি ব্যাটারি এবং কার্টিজ বা ট্যাংক।
কার্টিজে থাকে ই-জুস, যা তামাকজাত নিকোটিনসহ আরো কিছু রাসায়নিক সংমিশ্রনে তৈরি একটি তরল।
ব্যাটারি শক্তি উৎপন্ন করে এবং অ্যাটোমাইজার ই-জুসকে পরিণত করে এ্যারোসল বা বাষ্পে। ই-সিগারেট সেবনকারীরা সেই বাষ্প শ্বাসের সাথে গ্রহণ করেন। যে-কারণে এই ধূমপান পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে vaping।
ব্যাপারটা এমন নয় যে ভেপিং একেবারেই নতুন কিছু। ধূমপানের আদি ও বহুল ব্যবহৃত রূপটিকেই স্রেফ আধুনিকতার মোড়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নিকোটিনসহ ক্ষতিকর যে রাসায়নিক উপাদানগুলো আপনি বিড়ি-সিগারেটে পাবেন, প্রায়ই একই জিনিস আছে ই-সিগারেটেও। তবে সেবনরীতি এবং বাহ্যিক রূপটিতে কিছু নতুনত্ব বা অভিনবত্ব আনা হয়েছে।
যেমন- ডিজাইন। সব সিগারেট প্রায় একই মাপের হলেও ই-সিগারেটের আকার ও ডিজাইনে আছে বৈচিত্র। বাঁকানো পাইপ, কলম, ফোন কিংবা USB ড্রাইভ- এমন হরেক আকারের ই-সিগারেট পাওয়া যায়।
ই-জুসের মধ্যে বিভিন্ন ফলের ফ্লেভার মেশানো হয় বৈচিত্র আনার জন্যে। তাতে জিনিসটি একদিকে যেমন আকর্ষনীয় হয়, অন্যদিকে মুখ থেকে তামাকের গন্ধের বদলে বের হয় ফলের ঘ্রাণ। এতে কারো পক্ষে চট করে ধরে ফেলার উপায় থাকে না।
অর্থাৎ, তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করার সব ব্যবস্থাই আছে এতে!
আর এই আকর্ষণ থেকেই আসক্তি, যার পরিণাম ধূমপানের চেয়ে কম মারাত্মক তো নয়ই, বরং আরো বেশি। এটা যে স্রেফ কথার কথা নয় তা ই-জুসে থাকা কেমিকেলগুলোর ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে জানলে যে-কেউই বুঝতে পারবে।
নিকোটিন- শ্বাসযন্ত্রের নানা সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারের কারক।
কার্সিনোজেন- লন্ড্রি ও ডিশ ডিটারজেন্ট সামগ্রী, বডি ওয়াশ এবং কাঠের আসবাবপত্রে ব্যবহার করা হয়। ফুসফুসের রোগের পাশাপাশি হৃদরোগ এবং ক্যান্সার ঘটাতে সক্ষম।
অ্যাক্রোলিন- আগাছা মারার জন্যে ব্যবহৃত হয়। এটি ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ, এমনকি ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
ডায়াসিটাইল- ব্রঙ্কিওলাইটিস ওবলিটারানস বা ‘পপকর্ন লাংস’ (ফুসফুসের এক ধরনের রোগ) ঘটায়।
ডাইথিলিন গ্লাইকোল- বিষাক্ত রাসায়নিক, যা অ্যান্টিফ্রিজে ব্যবহৃত হয়। জটিল লাং ডিজিজ সৃষ্টি করে।
ক্যাডমিয়াম– শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগ তৈরি করে।
বেনজিন- উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যা যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পাওয়া যায়। অস্থিমজ্জার ক্ষতিসাধন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়।এমন আরো অনেক রাসায়নিক উপাদান মিলবে ই-সিগারেটে। আর যত বেশি উপাদান, বিষাক্ততা তত বেশি- এমনটাই দেখা গেছে নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায়।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেডিসিন কর্তৃক চার শতাধিক গবেষণা রিপোর্ট পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে একটি যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-সিগারেট সেবনে তরুণরা কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং হাঁপানি বৃদ্ধির মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। অল্পবয়সীদের মধ্যে ভেপিংজনিত অসুস্থতা ও প্রাণহানী আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সেবছর US Food and Drug Administration (FDA) ভেপিংকে মহামারীর পর্যায় বলে ঘোষনা করেছে!
অবশ্য American Lung Association এ-ব্যাপারে গত এক দশক ধরে FDA কে সতর্ক করে আসছিল।
কালোবাজারের ই-জুস প্রচলিত রাসায়নিকগুলো ছাড়াও অন্যান্য কেমিকেল ব্যবহার করে। যেমন- টেট্রাহাইড্রোকানাবিনল (THC)- গাঁজার সবচেয়ে স্বীকৃত উপাদান! আর এতে নেশার পরিমাণ এত বেশি যে, ভোক্তারা ডোজ ক্রমাগত বাড়িয়েই চলে।
এক কথায় উত্তর হলো- না! যদিও প্রচার-প্রচারণায় এহেন দাবি করা হয়, তবে আসলেই ধূমপান ত্যাগে সহায়তা করে এমন কোনো ই-সিগারেট FDA এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি।
আবার কিছু কিছু ই-সিগারেট কোম্পানী দাবী করে যে তাদের পণ্যে ক্ষতিকারক নিকোটিন নেই। তবে এটি সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর পাঁয়তারা বৈ কিছু নয়।