জীবন ধ্বংসকারী অভ্যাস ধূমপান; সূচনা যার নিছক কৌতূহল থেকে

দেশের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেইন স্মোকার এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি ধূমপান করেন কেন? তার উত্তর- এসএসসির পর কলেজে উঠে কিছুটা কৌতূহল থেকে ধূমপান শুরু করি। প্রথমে তেমন কিছু বুঝতে পারি নি। কিন্তু দিনে দিনে এটাই আমার সবচেয়ে জরুরী চাহিদায় পরিণত হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে তরুণেরা ধূমপান শুরু করে মূলত কৌতূহল থেকে। বলা চলে এটা এক ধরনের ফান্টাসি। 

প্রথমবার বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় ও অতি উৎসাহ থেকে অনেকে সিগারেট ‘টেস্ট’ করে থাকে। অনেকে আবার বিনোদনের অংশ হিসেবে সিগারেট খাওয়া শুরু করে। যারা একবার কৌতূহলবশত একটি সিগারেট পান করেছে তাদের অধিকাংশই পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে পুরাদস্তুর ধূমপায়ীতে।

যেসব ভ্রান্ত ধারণা তরুণ সমাজকে ধূমপানে প্ররোচিত করে

আমাদের দেশে অনেক তরুণ-তরুণীই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে ধূমপান শুরু করে। কারণ ধূমপানকে তারা মনে করছে আধুনিকতা বা তথাকথিত স্মার্টনেস জাহিরের উপায়। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই নারীরাও। আসলে বেণিয়ারা সুকৌশলে আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ধূমপান স্মার্টনেসের প্রতীক।

সিগারেটের বিজ্ঞাপনগুলোতে টিভি বা সিনেমা তারকাদের দিয়ে ধূমপান প্রমোট করতে দেখা যায়। এই তারকার ভক্ত-অনুসারীদের মধ্যে ধূমপান ইতিবাচক হিসেবে গৃহীত হবে এটাই স্বাভাবিক।

তবে আমাদের দেশে সিগারেটের বিজ্ঞাপন যেহেতু বর্তমানে নিষিদ্ধ, তাই ধূমপান প্রচারে বেণিয়ারা নিয়ে কৌশলী উদ্যোগ। 

নাটক-সিনেমায় যখন কাউকে ধূমপান করতে দেখানো হয় তখন বাধ্যতামূলকভাবে স্ক্রিনে দেখাতে হয় ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। কিন্তু আপনিই ভাবুন, কোনো জনপ্রিয় নায়ক বা মডেলের ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ঝুলতে দেখলে ওই ছোট্ট অক্ষরে লেখা সতর্কবার্তা কতটা কার্যকরী হবে? নিশ্চয়ই খুব একটা না!

আবার ধূমপান সতর্কবার্তা নিয়ে বড় বড় বিলবোর্ড আসলে সুচতুরভাবে ধূমপানেরই বিজ্ঞাপন! আর এসবের মধ্য দিয়ে তরুণ-যুবাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে ধূমপানের প্রতি।

ক্ষতির দিক বিবেচনায় বিড়ি-সিগারেটকে আপনি বলতে পারেন কালসাপ! 

কারণ সাপের মতোই এগুলোতেও আছে বিষ, যা সাপের বিষের মতোই মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম।

প্রায় সাত হাজার ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গেছে সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়ায়। এর মধ্যে একশটি উপাদান মারাত্মক বিপজ্জনক, ক্ষতি করে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের। 

স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, শ্বাসনালী ও ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, চোখ, ব্রেন, হাড়, ত্বক, দাঁতের মাড়ি, পাচনতন্ত্র অর্থাৎ, শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই বললেই চলে, ধূ্মপান যার ক্ষতি করে না। 

সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা উপাদানগুলোর মধ্যে ৭০টি উপাদান ক্যান্সার ঘটাতে সক্ষম। 

ফুসফুস, মুখ, কিডনি, লিভার, প্যানক্রিয়াস, পাকস্থলী, কোলন ও মলদ্বারের ক্যান্সার- অর্থাৎ বেশিরভাগ ক্যান্সারের কারণ সিগারেটের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলো। বর্তমানে যত মানুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তার ৯০ শতাংশের জন্যে দায়ী ধূমপান। 

ধূমপানের ক্ষতির কথা বলছেন তামাক কোম্পানির সংশ্লিষ্টরাও 

বিবিসি-র সাথে এক সাক্ষাতকারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (BAT)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিজেই স্বীকার করেন যে ধূমপান অনেক গুরুতর রোগের কারণ। তার মধ্যে ক্যান্সার বিশেষত ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ব্রংকাইটিসের মতো রোগগুলোর কারণ হচ্ছে ধূমপান।

তিনি বলেন, “For a lifetime smoker, about half of them can expect to die prematurely as a result of their cigarette smoking” 

অর্থাৎ, যারা নিয়মিত ধূমপান করেন তাদের ৫০ শতাংশ প্রত্যাশা করতে পারেন যে, তাদের অকালমৃত্যু হবে!

মাদকাসক্তির শুরু ধূমপান থেকে 

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। 

আসলে যারাই মাদকাসক্ত হয়েছে তাদের শুরুটা সবসময়ই হয়েছে কৈশোরে বা তারুণ্যে কৌতূহলবশত সিগারেটে টান দেয়ার মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে সেখান থেকে তারা প্রবেশ করেছে নেশার জগতে। 

সুতরাং প্রাথমিক অবস্থায় যদি আমাদের তরুণ-যুবসমাজকে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা যায় তাহলে তারা মাদকাসক্তির করুণ পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে পারে।

কাজেই ধূমপানের চোরাবালিতে পা দেবেন না 

ধূমপায়ীরা যে কেবল নিজেদেরই সর্বনাশ করে, তা নয়। পরোক্ষ ধূমপানের ফলে ধূমপায়ীর মতোই নিকোটিন প্রবেশ করে অধূমপায়ীর শরীরেও। ফলে নিজেরা ধূমপান না করেও ধূমপানের মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে আপনার বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান এমনকি গর্ভে থাকা শিশুও যদি আপনি ধূমপান করেন। 

কাজেই সচেতন হোন; ভুলেও পা বাড়াবেন না এই ক্ষতিকর অভ্যাসের দিকে। মনে রাখবেন, ধূমপান মানে বিষপান; আর একজন বুদ্ধিমান মানুষ কখনো জেনেবুঝে বিষপান করে না। 

আর ইতিমধ্যেই যদি আপনি ধূমপানে আসক্ত হয়ে থাকেন তাহলে এখনই বর্জন করুন এই অভ্যাস

University of Edinburgh's Usher Institute এর প্রধান গবেষক Dr. Peter Joshi বলেন- দিনে এক প্যাকেট সিগারেট আপনার গড় আয়ু থেকে সাত বছর কমিয়ে দেয়!

তবে সুখবর হলো, ধূমপায়ী ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণভাবে ধূমপান পরিত্যাগ করে তাহলে সে তার জীবনের হারানো সেই সাত বছর আবার ফিরে পেতে পারে।

যুক্তরাজ্যের Sanger Institute-এর Dr. Peter Campbell বলেন- কিছু কোষ থাকে যেগুলো অনেকটা জাদুকরীভাবেই শ্বাসনালীর প্রান্তগুলোকে পুনঃর্গঠণ করে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ৪০ বছর ধূমপান করার পরও যারা ধূমপান ছেড়েছে তাদের ক্ষেত্রেও অপরিবর্তিত কোষের মাধ্যমে সুস্থ কোষ পুনঃনির্মাণের ঘটনা ঘটেছে।

 

ধূমপান কীভাবে ছাড়বেন জানতে পড়ুনঃ

ধূমপান ছাড়ার ৮ ধাপ

ধূমপানের আসক্তি থেকে মুক্তির জন্যে মেডিটেশন