পেইনকিলারে ব্যথা নয়, ক্ষয় হয় প্রাণ!

ব্যথানাশক আসক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাজ্যজুড়ে এ এখন দেখা দিয়েছে এক নতুন মহামারী হিসেবে। সে-দেশের সরকার, বিভিন্ন রাজ্যের গভর্নর এবং স্বাস্থ্যবিদরা উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (২০১৬) প্রভাবশালী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পর্যন্ত সে-দেশের সাধারণ মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারণায়। দিতে হচ্ছে সুপরিকল্পিত প্রতিশ্রুতি যে, কীভাবে তিনি এই নীরব মহামারী প্রতিহত করবেন।

মূলত ওপোয়েড গোত্রীয় ব্যথানাশকগুলোই (মরফিন, অক্সিকোডোন, হাইড্রোকোডোন ইত্যাদি) তীব্র আসক্তি সৃষ্টি করছে ভোক্তাদের মাঝে। কারণ এগুলোর আর হেরোইনের রাসায়নিক গঠন (কেমিকেল স্ট্রাকচার) একই রকম! এছাড়াও দেহে হেরোইনের মতো একই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এই মরফিন। তাই ক্রনিক ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে মোটামুটি যারাই একবার এসব ওষুধ সেবন করছেন বা শিরাপথে ওপোয়েড জাতীয় ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন তারা জড়িয়ে যাচ্ছেন ভয়াবহ নেশার জালে। এমনকি বেড়ে যাচ্ছে এইডস রোগীর সংখ্যা! কীভাবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মরফিনের মতো ব্যথানাশকে আসক্ত হয়ে বাছবিচারহীনভাবে চলছে ইচ্ছেমতো ইঞ্জেকশন নেয়া। একই সুচ দিয়ে একাধিকবার এবং একাধিক জন ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন। এমনও ঘটনা আছে যে, একই ব্যক্তি দিনে ২০ বার পর্যন্ত ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন। কখনো আবার দেখা গেছে, একই পরিবারের তিন প্রজন্ম ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন একই সুচ ব্যবহার করে!

আর এদের অধিকাংশই এসব ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়ছেন চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, গোটা আমেরিকা জুড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ আর্থ্রাইটিস, মাইগ্রেন, ব্যাকপেইনসহ নানারকম ক্রনিক ব্যথায় আক্রান্ত। এ যেন এক ব্যথাভারাক্রান্ত জাতি! যা-হোক, এর ফলে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক আমেরিকান ব্যথার প্রতিকার চেয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন, আর চিকিৎসকরাও সমানে পরামর্শ দিচ্ছেন এসব ব্যথানাশকের। যারা আবার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র জোগাড় করতে পারছেন না, তারা ঠিকই এসব ওষুধ সংগ্রহ করে নিচ্ছেন কালোবাজার থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর মতে, ওপোয়েড সেবনকারী ৯৪ লক্ষ আমেরিকানের মধ্যে ২১ লক্ষই এতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং এরা এসব ওষুধের জন্যে কালোবাজারের খপ্পরে পড়ার ঝুঁকিতে আছেন।

আরো ভয়াবহ তথ্য হলো, প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চার জন হেরোইন সেবনকারী জানিয়েছেন, নেশার জগতে তাদের প্রবেশ ঘটেছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত ব্যথানাশক সেবনের পথ ধরে। আর যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ৪৬ জন মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুবরণ করছেন মরফিন ওভারডোজের কারণে। এবং হেরোইন সেবনজনিত কারণে মৃত্যুর হার এর দ্বিগুণ! বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন মধ্যবয়সী আমেরিকানরা। বর্তমানে যে-কোনো দুর্ঘটনা ও সহিংসতাজনিত মৃত্যুর চেয়েও অতিরিক্ত ওপোয়েড সেবনজনিত কারণে মধ্যবয়সীদের মৃত্যুহার সে-দেশে ঢের বেশি!

শুরুতে অবস্থা এমন ছিল না। বিশ শতকের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে ক্রনিক ব্যথার রোগীরা প্যারাসিটামল ও এসপিরিন জাতীয় ওষুধ সেবন করতেন। হেরোইনের জ্ঞাতি ভাই মরফিন তখন ব্যবহৃত হতো হাড় ভাঙা এবং সার্জারি-পরবর্তী ব্যথার ক্ষেত্রে, তা-ও খুব স্বল্পমেয়াদী ডোজে। আর দীর্ঘদিন মরফিন সেবনে এতে আসক্তির ঝুঁকি বাড়ে বলে দীর্ঘমেয়াদী ডোজে এটি ব্যবহৃত হতো কেবল অন্তিম পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীদের ব্যথামুক্তির জন্যে।

কিন্তু আশির দশকের শেষদিকে এসে পরিস্থিতি হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করে। যে-কোনো ক্রনিক ব্যথার জন্যেও চিকিৎসকেরা মরফিন জাতীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে শুরু করেন হরদম। যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রনিক ব্যথার ক্ষেত্রে মরফিনের উপযোগিতা যে সমস্ত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সে-সব খুবই দুর্বল মানের গবেষণা!

এছাড়াও গুরুতর অভিযোগের তীর উঠেছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসকদের জন্যে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে (মূলত ব্যথা নিরাময় বিষয়ক) বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে তারা। শুধু তা-ই নয়, ২০০৭ সালে সে-দেশের ‘ফেডারেশন অব স্টেট মেডিকেল বোর্ডস’-কে ব্যথা নিরাময় বিষয়ক একটি গাইডলাইন বুক প্রকাশের জন্যে মরফিন জাতীয় ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অনুদান দিয়েছে ৫ লক্ষ ৮৬ হাজার ডলারেরও বেশি অর্থ। ব্যথা নিয়ে ব্যবসা রীতিমতো জমজমাট!

তথ্যসূত্র : টাইম ম্যাগাজিন (১৫ জুন, ২০১৫)