published : ৫ জুন ২০২৩
আইবিএস (IBS) বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্ত্রের ব্যাধি, যা পেটের একটি পরিচিত ও বিরক্তিকর সমস্যা।
এই আইবিএস পরিপাকতন্ত্রের গঠনগত সমস্যা নয়, বরং ফাংশনাল বা কার্যগত সমস্যা। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ আইবিএস রোগে ভুগছেন। পাশ্চাত্যে প্রতি ১০ জনে অন্তত একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় এ রোগে আক্রান্ত হন।
২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৪.৬ শতাংশ মানুষ আইবিএস রোগে ভুগছেন। এই সমস্যা সাধারণত যুবা বয়সেই শুরু হয়ে থাকে এবং নারীরাই বেশি ভুগেন।
আইবিএস (IBS) বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্ত্রের ব্যাধি। (ছবিসূত্র : barta24.com)
সমীক্ষা আরও বলছে, প্রতি ১০০ জন পুরুষে ২০.৬ জন এবং ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭.৭ জন এ রোগে আক্রান্ত হন।
আইবিএস রোগীদের মধ্যে ১০ শতাংশ চিকিৎসকের কাছে যান। তাদের ২৫ শতাংশ রোগীর উপসর্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি তাদের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়ে থাকে।
আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত দীর্ঘদিন কষ্ট পান। চিকিৎসায় তেমন কোনো সুফল না পেয়ে চিকিৎসক পরিবর্তন করতে থাকেন।
আইবিএসের উপসর্গগুলো খুবই সাধারণ। পেটব্যথা হয়, তবে তা মলত্যাগ বা বায়ু নিঃসরণের পর কমে যায়। কোনো কিছু খেলে পেট ফুলে যেতে পারে। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে। আবার কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে।
আবার পায়খানার সঙ্গে অতিরিক্ত মিউকাস যাওয়া, মলত্যাগের পরও তৃপ্তি না পাওয়া, পেটের নিচের অংশের যে-কোনো এক পাশে বা মাঝখানে ব্যথা বা পেটের ভেতর অস্বস্তি, সকালের নাশতার পর দ্রুত মলত্যাগের চাপ অনুভব এসবই এর উপসর্গ।
এছাড়াও পেট ভরা ভরা লাগা, অতিরিক্ত বায়ু ত্যাগ, বদহজম, দীর্ঘমেয়াদি ক্লান্তি, পুরো শরীর ব্যথা এসবই আইবিএসের অতি পরিচিত উপসর্গ।
আইবিএসের কারণ সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব স্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। মূলত অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস ও অসুস্থ জীবনযাত্রা, কম ঘুম, মানসিক চাপ, উত্তেজনা, স্ট্রেস ও টেনশন এই রোগের জন্ম দেয়।
তবে এর চেয়েও চমকপ্রদ হলো- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইবিএস হওয়ার পেছনে শরীরের চেয়ে, মন বেশি জড়িত। এটি যতটা না শারীরিক তার থেকে অনেক বেশি মনোদৈহিক সমস্যা। অনেকের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র টেনশন করলেই পেটে সমস্যা দেখা দেয়। অন্য সময় দিব্যি ভালো থাকেন।
আইবিএস যতটা না শারীরিক তার থেকে অনেক বেশি মনোদৈহিক সমস্যা (ছবিসূত্র : www.anandabazar.com)
সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, আইবিএস একটি সাইকো-সোমাটিক-ডিজিজ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, আইবিএস রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণই রোগ নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র। যেসব খাবারে পেটের সমস্যা বাড়ে, সেসব খাবার প্রাথমিকভাবে এড়িয়ে চলতে হবে। খাবার গ্রহণে হতে হবে নিয়মানুবর্তী ও সময়ানুবর্তী।
আইবিএস সমস্যার প্রধান কারণ যেহেতু মানসিক তাই মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাই এর নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ের মোক্ষম উপায় হতে পারে। মনোদৈহিক রোগগুলোর ক্ষেত্রে মেডিকেশনের চেয়ে মেডিটেশন বেশি কার্যকর।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিশ্ব আইবিএস দিবস ২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি আইবিএস রোগীর জন্যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এই সেমিনারে চিকিৎসকগণ আইবিএস আক্রান্ত রোগীর মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়েছেন।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক টেড কেপচাক্ আইবিএস রোগীদের নিয়ে একটি গবেষণা চালান। যেখানে ওষুধ হিসেবে রোগীদের খাওয়ানো হয় সাধারণ কিছু সুগার-পিল। আইবিএস সারানোর ক্ষেত্রে যার আসলে কোনো ভূমিকাই নেই।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এসব রোগীরা তাদের রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান, কারণ তাদেরকে জানানো হয়েছিল যে, আইবিএসের সঠিক ও কার্যকরী ওষুধটিই তারা সেবন করছেন।
এ-গবেষণা থেকে বোঝা যায়, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা হতে পারে আইবিএস নিরাময়ের বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান।
আইবিএস কিন্তু অসংক্রামক ব্যাধি। বর্তমান বিশ্বে সংক্রামক ব্যাধির চেয়ে অসংক্রামক ব্যাধির প্রকোপই বেশি।
এই অসংক্রামক ব্যাধিমুক্ত থেকে সুস্থ কর্মক্ষম জীবনযাপন করতে সচেতন মানুষ এখন ঝুঁকছেন জীবনশৈলী পরিবর্তনের দিকে। আর জীবনশৈলী পরিবর্তন ও সুস্থ জীবনাচার অনুশীলনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ মাধ্যম হলো, দৈনন্দিন জীবনে মেডিটেশন চর্চাকে অন্তর্ভূক্ত করা। দিনে ২০-৩০ মিনিট মেডিটেশন চর্চা হতে পারে প্রশান্ত ও সুস্থ জীবনের পথে একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক।
আইবিএসের মতো মনোদৈহিক রোগগুলোর জন্য মেডিটেশন বেশি কার্যকর।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত বিশ্বে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই প্রেসক্রিপশনে সাইকোসোমাটিক রোগসহ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে মেডিটেশন চর্চার পরামর্শ দিচ্ছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও মেডিটেশনের নিরাময় ক্ষমতাকে জনকল্যাণে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে মেডিটেশনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মেডিটেশন এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। তাই চিকিৎসকগণও আইবিএস চিকিৎসায় রোগীদের মেডিটেশন চর্চার পরামর্শ দিতে পারেন অনায়াসেই।