published : ১৮ জুন ২০২৩
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, একবছরে সারা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩.৬ ভাগ মানুষ অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা জনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভোগে।
অন্যদিকে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩.৪ ভাগ মানুষ বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন নামক মানসিক স্বাস্থ্যব্যাধিতে আক্রান্ত।
এছাড়াও আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, শিশু-কিশোরদের ১৮ শতাংশের বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
শিশু-কিশোরদের এবং তরুণরাই বেশি বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই পরিসংখ্যানে সব বয়সী মানুষই অন্তর্ভুক্ত এবং যারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন বা যাদের রোগ চিহ্নিত বা ডায়াগনসিস করা হয়েছে, শুধুমাত্র তাদের সংখ্যাই পরিসংখ্যানে এসেছে।
আর যাদের পরীক্ষা করার সুযোগ নেই বা যারা এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র সচেতন নন, তাদেরকে হিসেবে যোগ করা গেলে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বৈ কম হতো না।
দুনিয়াব্যাপী এই দুটি মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যার প্রাদুর্ভাব কমবেশি সব দেশের জন্যেই এখন মাথাব্যথার কারণ। নেপথ্য কারণ যাই থাক, লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা গেলেই প্রাথমিক মোকাবেলা করা সহজ হবে।
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত এবং নিয়ন্ত্রণহীন উদ্বেগ, ভয় এবং আশঙ্কায় ভোগে। পাশাপাশি এর সাথে যুক্ত হয় কিছু শারীরিক লক্ষণ যেমন হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, কাঁপুনি, ঘাম, অস্থিরতা, অমনোযোগ, অনিদ্রা।
এই উপসর্গগুলো স্বাভাবিক নার্ভাসনেস বা স্ট্রেস অনুভূতি থেকে একেবারেই আলাদা। ফলে একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, আবেগ এমনভাবে প্রভাবিত হয় যে তাদের স্বাভাবিক যৌক্তিক আচরণও বদলে যায়। এমনকি জীবনের বিভিন্ন কার্জক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার একটা প্রবণতা তৈরি হতে থাকে।
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেকে সব কিছু থেকে একা করে ফেলে। (ছবি সূত্র : www.wkhs.com)
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের প্রকটতা এবং উপসর্গ নির্ভর করে ব্যক্তি কোন ধরনের উদ্বেগ সমস্যায় আক্রান্ত তার ওপর।
যেমন- জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (সাধারণ উদ্বেগজনিত ব্যাধি), সোশ্যাল ফোবিয়া, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়, পরিস্থিতি বা বস্তু নিয়ে ফোবিয়া ইত্যাদি।
ইংরেজিতে এর আরেক নাম মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার (MDD) যা ইদানিং ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগীরা সব কিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। (ছবি সূত্র : coloradorecoveryservices.org)
দুঃখ বা শোক খুব সাধারণ মানব অনুভূতি। কিন্তু দুঃখবোধ, হতাশা, শুন্যতা, কাজে আগ্রহহীনতা , কোনোকিছুতেই আনন্দ না পাওয়ার অনুভূতি যখন ক্রমশ বাড়তেই থাকে এবং এগুলো শেষ হবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না (সাধারণত সপ্তাহ দুয়েক বা তার চেয়ে বেশি সময়) বরং একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা, জীবনের মান মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে থাকে, তখন ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার বিষয়টি চলে আসে।
পূর্বে উল্লেখিত উপসর্গগুলো ছাড়াও ক্ষুধা, ওজন বৃদ্ধি/হ্রাস, অনিদ্রা/অতিরিক্ত ঘুম, মনোযোগহীনতা/মনোনিবেশ করতে না পারা, মনে রাখতে সমস্যা, সিদ্ধান্তহীনতা, নিজেকে মূল্যহীন মনে করা, সারাক্ষণ অপরাধবোধে ভোগা, এমনকি বার বার আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের উপসর্গ।
যখন মাত্রাতিরিক্ত এবং ক্রমাগত চলতে থাকে তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যেমন সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার হোক বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, দুটোরই যথাযথ ডায়াগনসিসের জন্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। তারা উপসর্গগুলোর সময়কাল, গভীরতা/প্রকটতা এবং ব্যক্তির জীবনে এর প্রভাব পর্যালোচনা করে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করেন। সেটা হতে পারে ওষুধ, থেরাপি কিংবা দুটোর সমন্বয়।
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, দুটোরই যথাযথ ডায়াগনসিসের জন্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। (ছবি সূত্র : www.compassioncareclinics.com)
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ওষুধের পরিপূরক হিসেবে মেডিটেশন বা ধ্যানের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। তবে অবশ্যই রোগীর সমস্যার ধরন ও প্রকটতা জেনে প্রয়োগ করতে হবে।
কারো কারো দক্ষ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে চর্চা করতে হতে পারে, কেউ আবার যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেই করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞের মতে, একজন মানুষের মধ্যে যে-কোনো আবেগ গত পরিবর্তন অনেক দিন ধরে দেখা গেলে এবং সেটা দৈনন্দিন কাজকে প্রভাবিত করলে তখনই সতর্ক হওয়া উচিৎ।
- মেডিটেশন বা ধ্যানের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার প্রক্রিয়া মনকে বর্তমানে কেন্দ্রীভূত রাখে। ফলে নেতিবাচক চিন্তা মনকে বিভ্রান্ত করতে পারে না।
- নিয়মিত মেডিটেশন যে-কোনো ব্যক্তির আত্ম-সচেতনতা বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ নিজের নেতিবাচক আবেগ এবং শারীরিক সংবেদন সম্পর্কে বেশ সচেতন করে তোলে। ফলে শরীর-মনে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায়।
- নিজেকে ক্ষমা করে উদারতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার মানসিকতা বাড়ায় মেডিটেশন। ফলে নিজের এবং চারপাশের বিভ্রান্তিকর চিন্তায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আস্তে আস্তে হ্রাস পায়।
- মেডিটেশনে ক্রমাগত ইতিবাচক চিন্তার ফলে ব্রেনের কর্মকাঠামো বদলে যায়, প্রত্যেক মুহূর্তকে অনুভব ও উপভোগ করতে এবং লালন করতে শেখায়। ফলে উদ্বেগ-বিষণ্নতার বদলে নিরাশ মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে।
- সময় পেলেই বাইরে হাঁটুন। সময় নিয়ে গাছ দেখুন, ফুলের ঘ্রাণ নিন অর্থাৎ প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকুন। এতে আপনার মন আরও সতেজ হবে এবং মেডিটেশনের স্বাদ আরও ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন এবং বিষণ্নতা উদ্বেগ দূর হবে।
- মেডিটেশন মানসিকভাবে দৃঢ়তা শেখায় ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায় ফলে বিষণ্নতার কারণগুলো ক্রমাগত উবে যায়।
নিরাময়যোগ্য এই মনোদৈহিক সমস্যা থেকে বের হতে তাই নিয়মিত মেডিটেশন করুন।