published : ৫ ডিসেম্বর ২০২১
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের বিরুদ্ধে একটি চমৎকার প্রতিষেধক হলো অ্যান্টিবায়োটিক। তবে এখন অনেকের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে। আইইডিসিআরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক হলো ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগৃহিত একটি উপাদান, যা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস বা এর বংশবৃদ্ধি রোধ করে। তবে কোনো কারণে কোনো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা কমে গেলে সেই ঔষধ খেয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না। এই অবস্থাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেও স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সেরে যেত তা সেবনে সেই রোগ আর সারে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হওয়ার প্রধান কয়েকটি কারণ হলো-
প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের জেনেটিক কোডে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। যার ফলে অ্যান্টিবায়োটিকটি সেই ব্যাকটেরিয়ার তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি হাসপাতালে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোতে সতর্কভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে না। রোগীদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে।
এতে বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রে রোগ নিরাময়ে কাজে আসছে না। অযৌক্তিক ব্যবহারে ওষুধটি অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য। আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাকির হোসাইন হাবিব অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যাবহারকে সাইলেন্ট প্যানডেমিক হিসেবে অভিহিত করে বলেন-
“বাংলাদেশে বহু মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসীতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। তাদের মধ্যে ধারণাই নাই যে এর ফলে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোন সংক্রমণ হলে সেটা আর কোন ওষুধে হয়তো সারবে না”
এ-কারণে আগে যে অ্যান্টিবায়োটিককে মনে করা হতো যে-কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ, তা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজই করছে না। বিশেষত আইসিইউতে থাকা অধিকাংশ রোগীর ইনফেকশনকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক তেমন একটা কাজ করতে পারছে না বলে জানান ডা. হাবিব।
অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যে-সব জীবাণুর লড়াই করার ক্ষমতা বেশী তাদের বলা হয় সুপারবাগ। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বাড়ার ফলে সুপারবাগের পরিমাণও বেড়ে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান বলেন, আজ থেকে ১৫ বছর পর খুব সম্ভবত দেশে অনেক সংক্রামক রোগীর শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না!
আইইডিসিআর বলছে, করোনাকালে ৮০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিকই ছিল বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয়!
করোনা নিরাময়ে কার্যকরী ও নির্ভরযোগ্য ওষুধ না থাকায় চিকিৎসাপদ্ধতি ছিল মূলত সিম্পটোমেটিক। মানে উপসর্গ বিবেচনায় যে অসুস্থতা নিরাময়ে যে ওষুধ লাগে সেটাই সেবন করেছেন বেশিরভাগ করোনারোগী। ফলশ্রুতিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হয়েছে বাছবিচার ছাড়াই।
অথচ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন কোনো ভূমিকা-ই নেই!
WHO প্রতিবছর ১৬-২২ নভেম্বর ‘বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ’ পালন করে থাকে। যার উদ্দেশ্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি।
বাংলাদেশেও অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সর্দি-কাশি-জ্বরের মত সাধারণ উপসর্গে অনেকেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন, যা একদমই ঠিক নয়।
আসলে সাধারণ সর্দি-কাশি বা জ্বর নিজে থেকেই সেরে যায়। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শরীরকে প্রয়োজনীয় সময়টুকু দেয়া জরুরি।
অবশ্য রোগের উপসর্গ তীব্র হলে এটি সেবন করতে পারেন। তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক; তার দেয়া মাত্রা, সময় ও মেয়াদ অনুসরণ করে।
অর্থাৎ, বিনা প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যেমন যাবে না, তেমনি ডোজ শেষ না করে একটু সুস্থ ঠেকলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।
এ-দুটো নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়া বহুলাংশে ঠেকানো সম্ভব হবে।
এ-বিষয়ে আরো পড়ুন-
কারো সর্বনাশ কারো পৌষমাস : করোনাভাইরাস মহামারিতে যারা লাভবান
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক গবেষণালব্ধ অভিমত-ওষুধ কোম্পানির মিথ্যা তথ্যে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের