published : ৫ অক্টোবর ২০২৫
"ঊষর মরুর ধূসর বুকে
একটি যদি শহর গড়ো,
একটি মানুষ মানুষ করা
তার চাইতে অনেক বড়"
ওমর খৈয়ামের কবিতার বাংলা এই অনুবাদের সারকথা সবচেয়ে বেশি মিল খায় বোধ হয় শিক্ষকতার সাথে। একক প্রয়াসে শহর-নগর-জনপদ তারা গড়তে না পারলেও এমন মানুষ তারা গড়তে পারেন, যারা বদলে দিতে পারে সভ্যতার চিত্র, হতে পারে লাখো মানুষের কাছে শূন্য থেকে পূর্ণতায় উত্তরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যিনি ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ নামে ইতিহাসে খ্যাত। কারণ ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি ছিলেন ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী, ভারতের ব্যালেস্টিক মিসাইলের উন্নতিতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এভিয়েশন নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন তার মনে গেঁথে দিয়েছিলেন তার শিক্ষক শিব সুব্রামানিয়া আয়ার।
আব্দুল কালাম তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন শিক্ষক সুব্রামানিয়া ‘পাখি কীভাবে ওড়ে’- এ নিয়ে লেকচার দিচ্ছিলেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে পাখির ডানা মাথা লেজ আঁকলেন, দেখালেন যে সে ওড়ার সময় ডানাটা কীভাবে ছড়ায়। তারপরে গতি পরিবর্তন বা ওপরে নিচে নামার জন্যে লেজকে কীভাবে ওপর-নিচে ডান-বাম করে।
ক্লাসের সেই ২৫ মিনিট লেকচার শোনার পর আব্দুল কালাম বললেন, আমি বুঝি নি!
সুব্রামানিয়া এরপর শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেলেন সমুদ্রের পাড়ে। যেখানে সবসময় গাংচিল ঝাঁক বেধে উড়ছে-নামছে। গাংচিলদের মাধ্যমে তিনি ছাত্রদের পাখির ওড়ার মেকানিকেল দিকগুলো বোঝালেন। দেখালেন, পাখির ফরমেশন আর ফাইটার প্লেনের ফরমেশন একইরকম!
সুব্রামানিয়ার ১৫ মিনিটের লেকচারটা শোনার পর আব্দুল কালাম বললেন- এবার বুঝেছি!
সেদিন পাখির ওড়ার প্রক্রিয়াটা তার মাথায় ঢুকে গেছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন- ওড়ার বিজ্ঞান বা অ্যাভিয়েশন তিনি আয়ত্ত করবেন! এবং শেখার জন্যে সবকিছু করবেন।
আব্দুল কালামের পরিবার ছিল হতদরিদ্র। পড়ালেখার খরচ চালাতে তিনি হকারিও করেছেন।
মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে তিনি অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্স নিলেন। অ্যারোনটিকেল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পূরণ করলেন নিজের স্বপ্ন। এতকিছুর নেপথ্যে অনুপ্রেরণা ছিল শিক্ষকের সেদিনের ছোট্ট লেকচারটা!
পড়ুন- ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের জীবনের ৬ শিক্ষণীয় ঘটনা
অনেক বাবা-মা সন্তানকে শুধু জন্মই দেন, স্বপ্ন দিতে পারেন না। তার রোল মডেল হতে পারেন না। দেখা যায় এমন ছেলেমেয়েও জীবনে বড় কিছু করেছে, কোনো একজন শিক্ষক তার মনে বড় হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন বলে। এই স্বপ্ন বুনে দেয়াটাই শিক্ষকের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
একজন দক্ষ ভাস্কর যেমন একখণ্ড নিরেট মূল্যহীন পাথরের মধ্য থেকে কালজয়ী ভাস্কর্য বের করে আনেন, তেমনি একজন সফল শিক্ষক তথাকথিত মেধাহীন শিক্ষার্থীর ভেতর থেকে বের করে আনতে পারেন মেধাবী সত্ত্বাকে তার বুদ্ধিদীপ্ত অনুপ্রেরণা দিয়ে। এজন্যেই শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর।
পড়ুন- শুদ্ধাচার : শিক্ষক হিসেবে ॥ শিক্ষার্থীদের সাথে
একবার এক শিক্ষক ক্লাসের শিক্ষার্থীদের আইকিউ টেস্ট নিলেন। দেখা গেল সবচেয়ে বেশি আইকিউ যে ছেলেটির সে ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চার, রোল নম্বর সবার শেষে। শিক্ষক তার মেধার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, একটু চেষ্টা করলেই ছেলেটি ক্লাস টপার হতে পারে।
আইকিউ টেস্টের রেজাল্ট আর স্যারের উৎসাহে ছেলেটির বিশ্বাসের স্তরে এলো পরিবর্তন; এতদিন সে নিজেকে মেধাহীন ভাবত বিধায় ভালো রেজাল্টের চেষ্টাও করত না। কিন্তু এরপর থেকে সে মন লাগিয়ে পড়তে লাগত। বার্ষিক পরীক্ষায় সত্যি সত্যিই ছেলেটি প্রথম হলো!
স্যার তখন গোমর ফাঁস করলেন- আইকিউ টেস্টে তিনি ইচ্ছা করেই ছেলেটিকে সবচেয়ে বেশি নম্বর দিয়েছিলেন! আর তাতেই ছেলেটি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল তারও অনন্য মেধা আছে। এই বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে দিয়েছে সামনের সারিতে।
অ্যানি সুলিভানকে অনেকেই না চিনলেও তার স্টুডেন্ট হেলেন কেলারের নাম প্রায় সবাইই জানেন।
মাত্র ১৯ মাস বয়সে হেলেন কেলার অসুস্থতাজনিত কারণে দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারান। ফলে পড়ালেখা তো দূর, যোগাযোগের সাধারণ দক্ষতাটুকুও তার গড়ে ওঠে নি। তাই শৈশবেই তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। এমন সময় তার জীবনে আসেন অ্যানি সুলিভান।
সুলিভানের বয়স তখন মাত্র ২০; আংশিকভাবে দৃষ্টিহীনও। কিন্তু হেলেনকে শেখাতে তার ধৈর্যের কোনো কমতি ছিল না। হেলেনের হাতে তিনি স্পর্শের মাধ্যমে আঙুল দিয়ে একেকটা শব্দ বানান করে লিখতেন। প্রথমটায় হেলেন কিছুই বুঝত না। কিন্তু একদিন সুলিভান হেলেনের এক হাতে লিখকেন “w-a-t-e-r” আর অন্য হাতে প্রবাহিত করলেন পানি। হেলেন বুঝে ফেলল শব্দের অর্থ হয়! ঘুরে গেল তার জীবন।
এভাবে শিক্ষকের অধ্যাবসায়ে ছোট্ট হেলেন দ্রুতই শত শত শব্দ শিখে ফেলল। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া এবং বহু ভাষা রপ্ত করেছিলেন তিনি। গাইড হিসেবে তার স্কুল-কলেজসহ পুরো জীবনে পাশে ছিলেন সুলিভান।
হেলেন ১৯০৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন র্যাডক্লিফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্নকারী প্রথম অন্ধ-বধির ব্যক্তি। পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন লেখক, রাজনৈতিক কর্মী এবং মোটিভেশনাল স্পিকার। তিনি তার শিক্ষক সুলিভান সম্পর্কে বলতেন, এই মানুষটি তাকে ‘দৃষ্টি’ এবং ‘শব্দ’ দান করেছেন, যা তার ছিল না।
জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করার প্রচেষ্টা মহামানবরা সবসময় করেছেন। এই প্রচেষ্টার পতাকাবাহী যারা তারাই হচ্ছেন শিক্ষক।
যুগে যুগে কালে কালে শিক্ষকরা এমন মানুষ নির্মাণ করেছেন, যারা জাতিকে দেশকে সমাজকে এবং সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছেন। তাদের পরিচিতির নেপথ্যে ছিলেন তাদের শিক্ষক; তাদের পরিচয় যত বড় হয়েছে, তাদের অর্জনের পেছনে তত বেশি ফুটে উঠেছে শিক্ষকের ভূমিকা।
তবে ভালো শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপরে কোনোকিছু চাপিয়ে দেন না। তাদের মধ্যে কৌতূহলটা জাগিয়ে দেন শুধু। বাকিটা শিক্ষার্থী নিজেই করেন। যেমনটা করেছিলেন এপিজে আব্দুল কালাম।
আসলে বাবা-মা হওয়াটা একটা জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু শিক্ষক এবং ছাত্রের সম্পর্কটা হচ্ছে মানসিক এবং আত্মিক। শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আত্মিক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন তখনই পারবেন তাদের মধ্যে কৌতূহল জাগাতে, স্বপ্নের বীজ বুনতে। এবং পরিণামে সফল জীবন গড়তে।
আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমরা সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানাই সফল জীবন গড়া সকল শিক্ষকের প্রতি।