published : ২৩ জানুয়ারি ২০২২
ভাবনা এক প্রচণ্ড শক্তি। ইতিবাচক ভাবনা ইতিবাচক বাস্তবতার জন্ম দেয়, মস্তিষ্কের অপরিসীম শক্তিকে নিজের কল্যাণে কাজে লাগাতে সাহায্য করে।
মনের শক্তি অসীম- এতে কোনোই সন্দেহ নেই। তবে এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন এই শক্তির ওপর বিশ্বাস।
বিজ্ঞানীদের মতে, সফল হতে হলে আপনার সাফল্য লাভের ক্ষমতায় বিশ্বাস থাকতে হবে। পারব বলে বিশ্বাস করলে আপনি অবশ্যই পারবেন।
রোল নম্বরের বিবেচনায় ছেলেটি ক্লাসে শেষ থেকে ‘প্রথম’! বসতো একেবারে শেষ বেঞ্চে।
একদিন ক্লাস টিচার শিক্ষার্থীদের আইকিউ টেস্ট নিলেন। দেখা গেলে সর্বোচ্চ আইকিউ ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটির!
ক্লাসের কেউই সেটা মানতে রাজি নয়; মানতে চায় না খোদ সেই ছেলেটিই! তবে টিচার বললেন, ক্লাসের রেজাল্টের সাথে আইকিউয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আইকিউ ভালো হলেও চেষ্টা ও অধ্যাবসায় না থাকলে কেউ ফার্স্ট হতে পারে না। তেমনি আইকিউ মোটামুটি হলেও চেষ্টা করলে যে-কেউই ক্লাসে ১ম হতে পারে।
স্যারের কথায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেল ছেলেটির মনোজগতে। তার মনে বিশ্বাস জন্মালো যে চেষ্টা করলে সে অবশ্যই ক্লাসে ১ম হতে পারবে। সে সেদিন থেকে ভালোভাবে পড়তে শুরু করলো। দেখা গেল, যেসব জটিল ম্যাথ সে আগে বুঝতো না সেটা এখন দিব্যি বুঝতে পারছে! প্রশ্নোত্তরগুলোও চমৎকার মনে থাকছে।
বছর ঘুরতে ফাইনাল পরীক্ষা। এবং তাতে ১ম হলো ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটি!
স্যার এবার গোমর ফাঁস করলেন- সেদিন আসলে কোনো আইকিউ টেস্টই ছিল না! তিনি আসলে দেখতে চাইছিলেন কাউকে উদ্বুদ্ধ করে তার ভেতর কতটা পরিবর্তন আনা যায়। আর তাইতো আইকিউ টেস্টে তিনি ইচ্ছে করেই সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছেন ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটিকে।
ছেলেটির ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়েছিল।
হয়ত বলবেন, ছেলেটা কঠোর পরিশ্রম করেছে বলে পেরেছে। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখবেন, সে পরিশ্রম করতে শুরু করেছে তখন থেকে যখন সে ফার্স্ট হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে এবং তা হওয়া সম্ভব বলে ভেবেছে।
অর্থাৎ, সে সফল হয়েছে আগে তার মনোজগতে। বাস্তব সাফল্য এসেছে তারপরে।
কারণ মনোজগতের রণভূমিতে যদি আপনি জয়ী হন তো বাস্তব রণক্ষেত্র, মানে জীবনযুদ্ধেও আপনি জয়ী হবেন। আর মনোজগতের রণক্ষেত্রে যদি পরাজিত হন তো হেরে যাবেন জীবনযুদ্ধেও। আপনার যত অর্থ-বিত্ত-সঞ্চয়ই থাকুক না কেন, সব ফুৎকারে উড়ে যাবে যদি আপনার মনোজগৎ ঠিক না থাকে।
আসলে জয়-পরাজয়, সাফল্য-ব্যর্থতা, শান্তি-অশান্তি, স্থিরতা-অস্থিরতা সবকিছুর উৎস হচ্ছে মনভূমি তথা ভাবনা। ভাবনার ওপরে যিনিই নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছেন, ভাবনাকে ভাবনার হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজের হাতে নিতে পেরেছেন তিনিই সফল হয়েছেন।
আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার যে ধারণা আধুনিক নিউরোসায়েন্স আমাদের দিয়েছে তা বিষম খাওয়ার মতোই।
তুলনা করলে ব্রেইনের দশ লাখ নিউরোনের প্রতিটিকে একেকটি সুপার কম্পিউটার বলাই যায়। তবে একটি কম্পিউটার যেমন নিজে থেকে কিছু করতে পারে না, তাকে প্রোগ্রাম/কমান্ড দিতে হয়; একই অবস্থা ব্রেইনের ক্ষেত্রেও। আর ব্রেইনের প্রোগ্রাম, অর্থাৎ ব্রেইনকে কী করতে হবে তার নির্দেশনা আসে অবচেতন মনের ভাবনা থেকে। কাজেই আপনি কী করতে পারেন তা ভাবতে না পারলে তা করবেন কী করে?
ধরুন, আপনার কম্পিউটারে অনেক ডাটা/তথ্য আছে। কিন্তু এই ডাটা ততক্ষণ পর্যন্ত অকার্যকর যতক্ষণ না সেগুলো প্রসেস হচ্ছে।
স্রষ্টা সমস্ত জ্ঞান দিয়ে রেখেছেন আমাদের ছোট্ট এই মস্তিষ্কের ভেতরে। এই জ্ঞানকে যদি আমরা ডাটা বলি তাহলে এগুলোর প্রসেসিং সিস্টেম হলো ভাবনা। আপনি আপনার দ্বারা যা যা করা সম্ভব বলে ভাববেন সেগুলো আপনার ব্রেইনের জন্যেও বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে।
কারণ ব্রেইন স্টাডি থেকে দেখা গেছে, ব্রেইন বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে ফারাক করতে পারে না। কাজের সময় যে মানসিক নির্দেশনা সে প্রদান করে একইরকম নির্দেশনা প্রদান করে ভাবনা বা কল্পনার সময়ও। যে-কারণে জ্ঞান ও কল্পনার মধ্যে সংঘাত হলে কল্পনা-ই জয়ী হয়।
এর সহজ একটি উদাহরণ হলো থ্রি-ডি সিনেমা। বিস্ফোরণের ফলে পাথরখণ্ড ছিটকে আসছে আপনার দিকে- রূপালি পর্দায় দেখা দৃশ্যটি যে মেকি তা আপনিও জানেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেই কাল্পনিক পাথরখণ্ড থেকে বাঁচতে আপনার হাত আপনা-আপনিই চোখের সামনে চলে এসেছিল, তাই না? কারণ ব্রেইন ভেবেছিল পাথরখণ্ডটি আসল; আর তাই ‘ফাইট রেসপন্স’ হিসেবে হাতকে নির্দেশ দিয়েছিল আত্মরক্ষার উদ্যোগ নিতে।
আসলে মনোযোগ, উপলব্ধি, পরিকল্পনা, স্মৃতিসহ ব্রেইনের অনেক ধরণের কর্মপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে কাল্পনিক চিত্র। এজন্যে ভাবনাকে বলা যায় সত্যিকার পারফরম্যান্সের প্রশিক্ষণ! যা বাড়ায় প্রেরণা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়; মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করে সাফল্যের জন্যে।
সাইকোলজি টুডের একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, জীবনে আপনি যেখানে যেতে চান বা যা হতে চান, মানসিক চর্চা তথা কল্পনা আপনাকে সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারে। সাফল্যের জন্যে আপনাকে গড়ে দিতে পারে আপনার ভাবনা।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে নাতান শারানস্কি নামের এক ইসরায়েলি কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে অবিভক্ত রুশ ফেডারেশনের কারাগারে ৯ বছর নিঃসঙ্গ বন্দিদশা কাটাতে হয়। এই সময়টাতে তিনি ভাবনাশক্তির ব্যাপক চর্চা করেন। তিনি মনে মনে দাবা খেলতেন এবং বলতেন “বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ আমি নেবই!”
বিস্ময়কর হলো, শারানস্কি সত্যি সত্যিই ১৯৯৬ সালে তৎকালীন দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেন! যদিও তিনি প্রফেশনাল দাবাড়ু নন।
সম্ভবত ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েতরাই প্রথম ক্রীড়াঙ্গনে ভিজুয়ালাইজেশন টেকনিক ব্যবহার শুরু করে মেন্টাল রিহার্সেল বা কাল্পনিক মহড়া হিসেবে। টেকনিকটি এরপর থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
সেলিব্রেটি গলফার টাইগার উডস ‘কল্পনায় জেতা’ টেকনিকটি চর্চা শুরু করেন একদম অল্প বয়স থেকে।
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন গলফার জ্যাক নিকলস বলেন, মনের চোখে আগে না দেখে আমি কখনো শট মারতাম না, এমনকি অনুশীলনেও না!
রিং-য়ে পারফরমেন্স বাড়াতে ভাবনার শক্তিকে ব্যবহার করতেন হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীও। কেবল ভেবেই ক্ষান্ত থাকতেন না, বিশ্বাসের জোর বাড়াতে রিং-য়ে নেমেই নিজে নিজে আওড়াতে থাকতেন 'I am the greatest!'
ভারত্তোলকদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যখন একজন ভারত্তোলক শতাধিক পাউন্ড ওজন তোলেন তখন তার মস্তিষ্কে যে প্যাটার্ন সক্রিয় হয়ে ওঠে, প্রায় একইরকম প্যাটার্ন সক্রিয় হয় যখন তারা স্রেফ ভারত্তোলনের কল্পনা করেন!
এমনকি বাস্তবিক শরীরচর্চার মতো কার্যকরী হতে পারেন কাল্পনিক শরীরচর্চা।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ফাউন্ডেশনের মনোবিদ গুয়াং ইউ দুই দল মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালান। একদল, যারা বাস্তবে শরীরচর্চা করেন এবং অন্যদল, যারা স্রেফ শরীরচর্চার কল্পনা করেন। গবেষণা শেষে তিনি দুই দলের শরীরচর্চার ফলাফল তুলনা করেন। দেখা গেল, যারা বাস্তবে শরীরচর্চা করেছে তাদের তাদের আঙুলের শক্তি ৫৩ ভাগ বেড়েছে, আর যারা মনে মনে শরীরচর্চা করেছে তাদের বেড়েছে ৩৫ ভাগ!
এ থেকেই বোঝা যায় ভাবনা বা কল্পনার কী অবিশ্বাস্য প্রভাব শরীর বা পেশীর ওপর পড়তে পারে।
৫৬ বছর বয়সী এক আমেরিকান বিল কোচেভার। ভুগছিলেন কোয়াড্রিপ্লেগিয়ায়। মেরুদণ্ডের যে স্নায়ুগুলো মস্তিষ্ক থেকে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নড়াচড়ার নির্দেশ বা অনুভূতির বার্তা পৌঁছে দেয়, কোনো কারণে সেগুলো জখম হলে একজন ব্যক্তি কোয়াড্রিপ্লেগিয়ায় আক্রান্ত হন, যার ফলে ঘাড় থেকে শরীরের নিচের অংশ অচল হয়ে যায়।
এমনটাই হয়েছিল বিল কোচেভারের। ৮ বছর ধরে তিনি ছিলেন পুরোপুরি বিছানাবন্দি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের সফল গবেষণায় তিনি তার হাত নাড়াতে সক্ষম হন। যার মাধ্যম ছিল তার কল্পনা।
দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণাটিতে কোচেভারের ব্রেইনের সাথে হাতের কৃত্রিম সংযোগ ঘটানো হয়। প্যারালাইজড হওয়ার আগে তার ব্রেনের যে অংশ হাতকে নিয়ন্ত্রণ করত, গবেষকেরা সেখান থেকে নির্গত সংকেত গ্রহণের জন্যে দুটি ইলেক্ট্রোড স্থাপন করেন। এরপর তাকে কল্পনায় হাত নড়াচড়া করতে বলা হয়। তিনি যখন কল্পনা করছিলেন তখন ইলেক্ট্রোড দুটি স্নায়ুবিক সংকেত সংগ্রহ করে হাতের পেশিতে সংযুক্ত ইলেক্ট্রোডে প্রেরণ করে।
ফলাফল- কল্পনাশক্তির জোরে কোচেভার দীর্ঘ আট বছর পর প্রথম নিজের হাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন। সক্ষম হন নাক চুলকানোর মতো সুক্ষ্ণ কাজ করতেও।
হয়তো আপনি যা পারবেন বলে ভাবছেন তা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বা সেটা করতে পারার নজির এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু ভাবনার জগতে যদি সেটাকে সম্ভব করতে পারেন তাহলে তা বাস্তবায়নও করতে পারবেন। প্রতিটি নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন সাইকেল মেকানিক। সাইকেল সারাতে সারাতে তাদের মনে হলো যান্ত্রিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আকাশে ওড়াও সম্ভব। তারা লেগে গেল উড়ুক্কু যন্ত্র আবিষ্কারে। চারপাশের মানুষ তাদের ‘পাগল’ আখ্যা দেয়। রাইট ভাইয়েরা কিন্তু তাতে দমে নি। তারা ঠিকই বিমান আবিষ্কার করে ফেলে। যা পরবর্তীতে পাল্টে দেয় সভ্যতার চিত্র।
কাজেই ভাবুন আপনি কী কী করতে পারেন। বাড়ান ভাবনার শক্তি।
জীবনে বড় কিন্তু সুস্পষ্ট একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। এরপর কল্পনায় ভাবুন লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্য অর্জনের চিত্রটি সবসময় মনের সামনে রাখুন। লক্ষ্য অর্জিত হলে আপনার পারিপার্শ্বিকতা কেমন হবে তা যথাসম্ভব বিশদে ভাবুন।
ধরুন, আপনি অনেক বড় একজন ডাক্তার হবার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। কল্পনা করুন আপনি ডাক্তার হয়ে গেছেন! আপনার চারপাশে কারা আছে? কী বলছে তারা? আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে? বাতাসে কি কোনো ঘ্রাণ অনুভব করছেন? অর্থাৎ, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সবক’টিকেই কাল্পনিক চিত্র নির্মাণে কাজে লাগেন।
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ-সংশয় এসে বিশ্বাসের দেয়াল নড়িয়ে দিতে চায়? কোনো অসুবিধা নেই! ক্রমাগত ভাবনা চালিয়ে যান। সবসময় ইতিবাচক থাকুন, ইতিবাচক ভাবুন, ইতিবাচক মানুষের সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হোন। এড়িয়ে চলুন নেতিবাচক মানুষের সঙ্গ।
প্রয়োজনে মেডিটেশনেও ভাবুন। আর যখনই সময় পান মনে মনে বলুন ‘‘ইনশাল্লাহ, সব সম্ভব’। ভাবনার এই নিয়মিত অনুশীলন আপনাকে এনে দেবে ঈর্ষণীয় সাফল্য।