দুধ-চায়ের আসক্তি কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ

২০১৩ থেকে ২০১৮। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে গ্রিন টি-র ব্যবহার বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। সাধারণ মানুষ এখন আগের চেয়ে স্বাস্থ্যসচেতন। তাই তাদের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে ইতিবাচক এ পরিবর্তন।

একসময় শহরের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের টং দোকান, সর্বত্র ছিল দুধ-চায়ের জয়জয়কার। নব্বই দশকের গোড়ায় কোয়ান্টাম দুধ-চায়ের স্বাস্থ্যগত অপকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে শুরু করে। তখন বহু ঘোরাঘুরি করেও কোনো চায়ের দোকানে রং-চা পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। চা বলতেই বাঙালি বুঝত ঘন দুধ, চা-পাতা আর চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু (!) পানীয়। মজার বিষয়, ৭০-৮০ বছর আগেও চায়ের ব্যাপারে বাঙালির বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। দুধ-চা এদেশে কীভাবে সর্বজনীন পানীয়ে পরিণত হলো সে ইতিহাস বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

বাঙালির হেঁশেলে চায়ের অনুপ্রবেশ

ভারতবর্ষে চায়ের উৎপাদন শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। তারা যখন দেখল ইউরোপের চাহিদা মেটানোর পরও বিপুল পরিমাণ চা রয়ে যাচ্ছে, তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এ অঞ্চলের মানুষকে চায়ের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলতে হবে। ১৯৪০-এর দশকে ঢাকাবাসীকে চা পানে অভ্যস্ত (নাকি আসক্ত!) করার জন্যে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা অভিনব উপায় বের করে।

পুরনো ঢাকায় তারা কয়েকজন চা-ওয়ালা নিয়োগ করে। এরা প্রতিদিন রাস্তার পাশে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চা তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে বসে থাকত। সবাইকে বিনামূল্যে চা পরিবেশন করতো। নতুন এসব গ্রাহকের কাছে চা-কে সুস্বাদু পানীয় হিসেবে জনপ্রিয় করার জন্যে চা-ওয়ালারা বেশি করে দুধ ও চিনি মেশাত। যেসব ক্রেতা চায়ের প্রতি অধিক আগ্রহ দেখাত, কোম্পানির নির্দেশ অনুযায়ী চা-ওয়ালারা তাদের কিছু শুকনো চায়ের পাতাও দিয়ে দিত।

সেইসাথে চা উৎপাদনকারী ব্রিটিশ কোম্পানি ঢাকার কয়েকটি স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে শিক্ষার্থীদের বিনা পয়সায় চা দেয়া শুরু করল। এই কার্যক্রম চলল টানা একবছর। তারপর বিনামূল্যে চা বিতরণ বন্ধ হলো। কিন্তু ইতোমধ্যেই ঢাকাবাসী চায়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠেছে চায়ের নিয়মিত ভোক্তা! কোম্পানি তখন পাড়ার মুদি দোকানে চা-পাতা সরবরাহ শুরু করল। এখন কিনে খাও।

একপর্যায়ে অনেক মানুষ যখন চা পানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল তখন মহল্লার দোকান থেকে নামী রেস্টুরেন্ট—সর্বত্র চা পরিবেশন চালু হয়ে গেল। অচিরেই ব্যাঙের ছাতার মতো ছোট ছোট চায়ের দোকানে ছেয়ে গেল ঢাকা শহর। দুর্বার গতিতে চলল চায়ের জয়যাত্রা। কিন্তু চায়ের সাথে দুধের মিশেল মোটেও স্বাভাবিক নয়। বরং আপনার পাকস্থলী বেচারার জন্যে অতি অস্বাভাবিক।

আরো পড়ুন আর্টিকেল সাইটে : দুধ-চা পান করলে চায়ের গুণ থাকে না

চা : একটি স্বাস্থ্যকর পানীয়

চায়ের মধ্যে রয়েছে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও অন্যান্য যৌগ, যা ক্যান্সার, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে; স্থূলতা ও কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং মস্তিষ্ককে সতেজ চনমনে করে।

২০০৭ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ১৬ জন নারীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। তাদেরকে রং-চা, দুধ-চা ও গরম পানি পান করতে দেন গবেষকরা। এরপর রক্তনালীর ওপর পানীয়গুলোর প্রভাব মাপা হলো। দেখা গেল, গরম পানির তুলনায় রং-চা রক্তনালীর প্রসারণ ঘটাতে অধিক কার্যকরী। কারণ চা-তে থাকে ক্যাটেচিন নামক এন্টি-অক্সিডেন্ট। হৃৎসুরক্ষায় যা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে যদি চায়ের সাথে দুধ মেশানো হয়, দুধের মধ্যে থাকা কেজিন নামক প্রোটিন নষ্ট করে দেয় ক্যাটেচিনের উপকারী প্রভাব।

ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে গবেষকরা জানান, ব্রিটিশরা পৃথিবীর শীর্ষ চা পানকারী জাতিগুলোর একটি। তবু তাদের হৃদরোগ প্রতিরোধে চা কোনো অবদান রাখছে না। কারণ প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ ব্রিটিশ দুধ-চা পানে অভ্যস্ত। গবেষক দলের প্রধান ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ভেরেনা স্ট্যাঙ্গল বলেন, দুধ মেশালে চায়ের টিউমার-প্রতিরোধী উপাদানের কার্যকারিতাও ব্যাহত হয়।

২০১২ সালে আরেক দল গবেষক চায়ের সাথে ডেইরি দুধের পরিবর্তে সয়াদুধ মিশিয়ে পরীক্ষাটি চালান। দেখা যায়, ফলাফলে কোনো হেরফের নেই। চায়ের সাথে যে-ধরনের দুধই মেশানো হোক না কেন, চায়ের গুণাগুণ বিনষ্ট হবেই।  

অন্যদিকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে চা কোনো ভূমিকা রাখে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার। তারা দেখেন, চায়ের প্রভাবে অগ্ন্যাশয় থেকে সাধারণের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। কিন্তু দুধ মেশালে ঘটে উল্টোটা, ইনসুলিন নিঃসরণের হার কমতে থাকে। চায়ে যদি ৫০ গ্রাম দুধ মেশানো হয়, তাহলে ইনসুলিনের নিঃসরণ শতকরা ৯০ ভাগ কমে যায়। ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে থাকে। তাই নিয়মিত দুধ-চা পান করার অভ্যাস ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার মোক্ষম উপায়!

সাম্প্রতিককালে একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, গ্রিন টি শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নেদারল্যান্ডের ম্যাসট্রিক্ট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের গবেষক রিক হার্সেল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালিয়ে জানিয়েছেন, চায়ের কাপে যখন দুধ ঢালা হয়, মেটাবলিজম প্রক্রিয়ার ওপর গ্রিন টির ইতিবাচক প্রভাব উধাও হয়ে যায়।

চায়ে দুধ না হয় না মেশালেন। একটু চিনি মেশালে কি ক্ষতি হবে? হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অধ্যাপক কী সান বলেন, গ্রিন টি পানের উপকারিতা পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয় চিনি। 

এসব গবেষণালব্ধ তথ্য দৈনিক সংবাদপত্র, অনলাইন হেলথ ব্লগ, স্বাস্থ্যবিষয়ক টিভি প্রোগ্রামে আজকাল হরদম প্রচার করা হচ্ছে। আর কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যরা দুধ-চা পানের অপকারিতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সেই ১৯৯৫ সাল থেকে।

কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে সঠিক খাদ্যাভ্যাস-বিষয়ক আলোচনায় গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতক বলেন, দুধ ও চা—দুটিই উপকারী পানীয়। কিন্তু এ দুটোকে একসাথে মেশালে এমন একটি যৌগ উৎপন্ন হয় যা পাকস্থলী হজম করতে পারে না। ফলে কেউ পর পর ৮-১০ কাপ দুধ-চা খেলে তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হবেন। আর রং-চা পান করলে এনার্জি লেভেল বেড়ে যাবে। রং-চায়ের চেয়েও উপকারী হলো গ্রিন টি। 

কোয়ান্টাম সদস্যরা তাই নিজেরা যেমন দুধ-চা পরিহার করেছেন, পরিচিতদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলেছেন। ২৫ বছরের এই নীরব প্রচেষ্টার প্রতিফলন এখন জনজীবনে দৃশ্যমান।

বাংলাদেশে ক্রমেই বড় হচ্ছে গ্রিন টির বাজার

স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের অনেকেই সকালটা শুরু করেন দুধ-চিনিহীন চা দিয়ে। যারা আরো সচেতন তারা বেছে নিচ্ছেন গ্রিন টি। চা পানের অভ্যাসে এই পরিবর্তন এসেছে কয়েক বছরের মধ্যে। সাধারণ চায়ের চাহিদা যেখানে বাড়ছে ৫ শতাংশ হারে, গ্রিন টির চাহিদা বাড়ছে ১৫ শতাংশ হারে। পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশে গ্রিন টি উৎপাদন করত মাত্র দুটি কোম্পানি। চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে, এখন ছয়টি কোম্পানি সবুজ চা বাজারজাত করছে।

বাংলাদেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩,১৭০ কেজি গ্রিন টি আমদানি করা হয়েছিল। গত অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ২৩,৫১০ কেজি! এ দেশের মানুষ দুধ-চায়ের বিষাক্ত প্রভাব অচিরেই কাটিয়ে উঠতে পারবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

[তথ্যসূত্র : হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং, সেপ্টেম্বর ২০১৪; দ্য গার্ডিয়ান, ৯ জানুয়ারি ২০০৭; নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২; দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল ২০১৯; বণিক বার্তা, ১৫ মে ২০১৪]