১৪০০ বছর পরেও যে দৃষ্টান্ত প্রেরণা জোগায়!

সঙ্গীদের নিয়ে একদিন তিনি বসে আছেন। এমনি সময়ে এক বেদুইন এসে হাজির। সাহায্য চাইতে এসেছে। কিন্তু সাহায্যপ্রার্থীর কোনো বিনয় তার মধ্যে নেই! বরং বেদুইনদের মধ্যে স্বভাবসুলভ যে ঔদ্ধত্য থাকে, শিষ্টাচার জ্ঞানের অভাব থাকে, তার মধ্যেও তা-ই ছিল।

কিন্তু নবীজী (স) তাকে কিছুই বললেন না। বরং ভালো পরিমাণ অর্থসাহায্য করলেন তাকে। কিন্তু মূর্খ বেদুইন তাতে সন্তুষ্ট হলো না। ধমকের সুরে বলে উঠল, এটা কী দিলেন! এত কম সাহায্য! আপনার কাছ থেকে এটা আশা করি নি, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গজরাতে লাগল!

এদিকে সঙ্গীরা ভেতরে ভেতরে খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। প্রিয় নবীজীর (স) সাথে এ কি আচরণ! মূর্খ এই লোকটি কি জানে সে কার সাথে কথা বলছে! কত সম্মানিত একজন মানুষ তিনি! আহাম্মকটাকে একবার হাতের নাগালে পেলে হয়!

সঙ্গীদের মনোভাব বুঝতে পেরে নবীজী (স) তাড়াতাড়ি তাকে সাথে করে নিজের বাসায় চলে গেলেন। তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত দিতেই লাগলেন তাকে। যখন সে তৃপ্ত হলো, নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি তুমি সন্তুষ্ট? সে বলল, হাঁ, এবার ঠিক আছে।

নবীজী বললেন, তাহলে তুমি এখন যা করবে, তা হলো তোমার এই তৃপ্তির কথা, সাহায্য পেয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা তুমি আমার সঙ্গীদের কাছেও ব্যক্ত করবে। কারণ একটু আগে তুমি যা করেছ তা তাদেরকে বেশ কষ্ট দিয়েছে।

বেদুইন বলল, ঠিক আছে। এরপর সে নবীজীর (স) সঙ্গীদের সামনে গিয়েও তার সন্তুষ্টির কথা ব্যক্ত করল। সে যে নবীজী এবং তার পরিবারের জন্যে দোয়া করেছে সেটা জানাল।

সঙ্গীরা আশ্বস্ত হলেন। বেদুইন চলে গেল।

এরপর নবীজী তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ এই বেদুইন এবং আমার মধ্যে আজ যা হলো তাকে এমন এক উট মালিকের সাথে তুলনা করা যায় যার উট তার রশি ছিঁড়ে পালিয়েছে। মালিকের সাথে আশপাশের লোকেরাও ছুটছে উটটাকে ধরার জন্যে। কিন্তু যত তারা উটকে ধাওয়া করে, উট ততই ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়। অনেকক্ষণ এরকম চলার একপর্যায়ে মালিক বলে উঠল, দেখ, এভাবে একে বাগে আনা যাবে না। তার চেয়ে বরং তোমরা সবাই সরে যাও। আমার উটকে আমার হাতেই ছেড়ে দাও। আমি জানি, কীভাবে একে সামলাতে হবে। এই বলে সে কিছু ঘাস তুলে ধরে তার উটকে সেই বিশেষ ভাষায় ডাকতে লাগল অন্যসময় সে যে ভাষায় ডাকে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই উট ফিরে এল মালিকের কাছে। মালিক তখন তার গলায় রশি পরিয়ে দিল।

একইভাবে প্রথমবার ঐ বেদুইনের আচরণ দেখে তোমরা যখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলে, আমি যদি তখন ওকে তোমাদের হাতে ছেড়ে দিতাম তখন না ওকে সন্তুষ্ট করা যেত, না পাল্টানো যেত তার আচরণ! উল্টো চলে যাওয়ার পর হয়তো আরো বেশি মূর্খতা, অশিষ্টাচারের মধ্যে সে ডুবে যেত।

নবীজীবনের এ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে প্রখ্যাত সীরাত ‘তাফসির ইবনে কাসিরে’। ছোট্ট এই ঘটনাটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের যে শিক্ষাটি আমরা পাই, শুধু সেই অনুশীলনই যদি আমরা করতাম তো আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজ অনেক সহনশীল, অনেক শান্তিপূর্ণ, অনেক মমতাময় হয়ে উঠত। দোষ-ত্রুটি চোখে পড়ামাত্রই যে কাউকে পরিত্যাগ করতে নেই; একটু ধৈর্য, একটু সহনশীলতা একটু মমতা দিলে সেই মানুষটিও যে একসময় শুভ চেতনার অনুসারীতে রূপান্তরিত হতে পারে- এ শিক্ষাই আমরা পাই নবীজীর (স) এ ঘটনায়। ১৪০০ বছর আগেও সামাজিক সম্পর্কে মানবিকতার যে দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়ে গেছেন, আজও তা একইরকমভাবে শুধু নয়, যেন তার চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক!

আরেকদিন বিবি হাফসার ঘরে তিনি অবস্থান করছিলেন। জ্বরে আক্রান্ত হবার কারণে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এসময় বিবি আয়েশার এক দাসী এল তার জন্যে এক বাটি বার্লির স্যুপ নিয়ে। কিন্তু বিবি হাফসা ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারলেন না। তিনি মনে করলেন, আজ রাতে নবীজী (স) যেহেতু তার ঘরে আছেন, কাজেই নবীজীর পুরো অধিকার তার। বার্লির স্যুপ পাঠিয়ে আয়েশা তার সে অধিকারকে লঙ্ঘন করেছেন। আবেগপ্রবণতার একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি স্যুপের বাটি ছুঁড়ে ফেললেন। মাটির বাটি ভেঙে গেল, স্যুপ গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

কিন্তু নবীজী শান্ত! হাফসাকে কিছুই বললেন না। শুধু উঠে গিয়ে ভাঙা বাটির একটা টুকরো তুলে নিলেন যাতে তখনো কিছুটা স্যুপ লেগে ছিল। চেটেপুটে সেটুকুই খেয়ে নিয়ে দাসীকে বললেন, আয়েশা যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি স্যুপ খেয়েছি কি না তাহলে তাকে বলবে যে আমি খেয়েছি। আর এখানে যা দেখলে তার কিছুই তাকে বলার দরকার নেই! আমি চাই না, আজকের ঘটনা নিয়ে আয়েশা আর হাফসার মধ্যে পরে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।

এ ঘটনার পরই নাজিল হয় সূরা কলমের চার নম্বর আয়াত, “তুমি নিশ্চিতভাবেই নির্মল চরিত্রে অধিষ্ঠিত।”

অর্থাৎ পারিবারিক একটি উত্তেজনার পরিস্থিতিকেও তিনি কত প্রো-একটিভভাবে মোকাবেলা করেছেন! এবং এ ঘটনাটিও আমাদের এখনকার দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ পারিবারিক জীবনের জন্যে খুব চমৎকার একটি শিক্ষা! পারিবারিক উত্তেজনার সময়গুলোতে স্বামী বা স্ত্রী যদি নবীজীর (স) মতো প্রো-একটিভ থাকতে পারেন, সহনশীল হতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের পারিবারিক জীবন অনেক প্রশান্ত, মমতাময় হয়ে উঠবে।

ঈদে মিলাদুন্নবীর এদিনে আসুন আমরা মানুষ মুহাম্মদের (স) জীবন থেকে এ মানবিকতার শিক্ষাই নিই।