যাকাত দিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে

published : ২৯ জুলাই ২০১৭

যাকাত কেন সঙ্ঘবদ্ধভাবে দিতে হবে, আমরা যখন এ বিষয়ে একটু জানার চেষ্টা করি এবং সঠিক বিষয়টি উপলব্ধি করি তখনই যাকাত কী, কেন যাকাত দিতে হয়, যাকাত দেয়ার গুরুত্ব কী, কারা যাকাত দেবেন এবং কারা যাকাত গ্রহণ করতে পারবেন- এসব আনুসঙ্গিক বিষয় আরো অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।

রসুল (স) এবং তাঁর অনুসারীরা যেভাবে যাকাত আদায় করেছেন

কোনো ধর্মের নীতিমালা সঠিকভাবে বুঝতে হলে ঐ ধর্মের প্রবর্তক কিভাবে তা চর্চা করেছেন, সেদিকে লক্ষ করা বাঞ্ছনীয়। ইসলামের নীতিমালার মূল নায়ক হচ্ছেন নবীজী (স)। তিনি কোনো কাজ যেভাবে করেছেন, সেভাবে করাই হলো সঠিক পদ্ধতি।

আমরা দেখি, নামায ফরজ হওয়ার পরে নবীজী ও তাঁর অনুসারীরা নামায শুরু করলেন। রোজা ফরজ হওয়ার পর সবাই যার যার রোজা রাখতে লাগলেন। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়ার পরে নবীজী বা কোন সাহাবা যেমন, হযরত আবু বকর (রা) বা অন্য কেউ তার যাকাতের অর্থ বা খেজুর নিয়ে বের হয়েছেন অথবা কাউকে ডেকেছেন যে, তোমরা আস, আমি যাকাত দেবো, এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাই না। কারণ যাকাত এ পদ্ধতিতে আদায় করা হয় নি।

২য় হিজরিতে যাকাত ফরজ হওয়ার পর রসূলুল্লাহ (স) যাকাত ফান্ড গঠন করেছেন। তিনি যাকাতের জন্যে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দিয়েছেন। তারপর ঘোষণা এসেছে, যাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ আছে, তাদের যাকাত দিতে হবে। সময়মতো যাকাতের সম্পদ প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে এবং জানানো হয়েছে যে, যাকাত আদায়কারী কর্তৃপক্ষ বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছে। তবে কেউ চাইলে কেন্দ্রে এসেও যাকাত জমা দিতে পারে।

এরপর আবার ঘোষণা দিয়ে যাকাত যারা পেতে পারে তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে এবং তালিকা ধরে তাদের কাছে যাকাত পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায় করাই হলো নবীজীর (স) পদ্ধতি।

ব্যক্তিগতভাবে কি যাকাত আদায় করা যায়?

ব্যক্তিগতভাবে যাকাত হিসাব করা, যাকাত পরিশোধ করা এবং ভিক্ষার মতো করে যাকাত দেয়া (যা দিয়ে কে‌উ স্বাবলম্বী হতে পারে না, যেভাবে আমাদের সমাজে চালু আছে) ত্রুটিপূর্ণ। আসলে যাকাতদাতাকে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত বিতরণ করার কোনো এখতিয়ার দেয়া হয় নি।

আমরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, আমি কি অমুক জায়গায় যাকাত দিতে পারব? জবাব হলো- যাকাতের মূলনীতি একটিই। আপনি ফান্ডে যাকাত দেবেন। যাকাত কর্তৃপক্ষ ভাববে এটি কোথায়, কতটুকু ব্যয় করা যায়। তবে আপনি প্রয়োজনে কতৃপক্ষকে পরামর্শ ও মতামত জানাতে পারেন। কিন্তু আপনার ওপর যে যাকাতটুকু ফরজ হয়েছে, সেটি আপনি কোথায় কোথায় দিতে পারেন, এই প্রশ্ন করার অধিকার আপনাকে দেয়া হয় নি। আপনি শুধু একটিই প্রশ্ন করতে পারেন, কোন জায়গায় দেব? কোন ফান্ডটি গ্রহণযোগ্য?

এ ব্যাপারে আল কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। যাকাত তো শুধু (এক) দরিদ্র, (দুই) অক্ষম, (তিন) যাকাত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মচারী, (চার) যাদের মন জয় করা প্রয়োজন, (পাঁচ) মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্যে, (ছয়) ঋণজর্জরিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে, (সাত) আল্লাহর পথে (জনকল্যাণমূলক কাজ, ধর্মপ্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে) এবং (আট) মুসাফিরদের জন্যে ব্যয় করা যাবে। (যাকাতের অর্থ ব্যয়ে) এটাই আল্লাহর বিধান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। [সূরা তওবা : ৬০]

হযরত মা'আজ ইবনে জাবাল (রা) কে যখন (হিজরী ১১ সনে ইয়ামেনের) গভর্নর করে পাঠানো হয়, তখন রসূলুল্লাহ (স) একটি দীর্ঘ নীতিমালা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তাকে একটি একটি করে নির্দেশনার বাস্তবায়ন করতে বলেছিলেন। প্রথমে বললেন, তুমি কালেমা বা বিশ্বাসের দাওয়াত দেবে। যদি অধিবাসীরা তা মেনে নেয় তখন নামাযের দাওয়াত দেবে। যদি তাও মেনে নেয় তারপরে যাকাতের কথা বলবে। যাকাত ধনীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে এবং গরীবদের মধ্যে বিতরণ করবে।

যাকাত যে ব্যক্তিগতভাবে আদায় করা যায় না, তার আরো প্রমাণ রয়েছে। একবার নবীজী (স) যাকাত সংগ্রহকারীদের  নির্দেশনা দেন, তোমরা যাকাতদাতাদের ভালো ভালো জিনিসগুলো আনবে না। গড়পড়তা করে ভালো-মন্দ মিলিয়ে আনবে। আবার যাকাতদাতাদেরকে নির্দেশনা দেন, যখন যাকাত সংগ্রহকারীরা আসেন তখন তোমরা বেছে বেছে কেবল খারাপ মালগুলো দেবে না। (কারণ আমরা জানি, যাকাত বলতে শুধু টাকা পয়সা বোঝায় না, ফল-ফসল, উট-বকরীও বোঝায়।)

যাকাত দেয়া একটি মর্যাদার ব্যাপার

ছোটবেলা থেকে আমরা যাকাত নিয়ে নানারকম সামাজিক রসম রেওয়াজ দেখে অভ্যস্ত। এজন্যে যাকাত প্রসঙ্গ উঠলে আমাদের অনেকের কাছেই বিষয়টিকে হালকা বা কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। অথচ বছর শেষে সুক্ষ্মভাবে হিসাব-নিকাশ করে যাকাত আদায় করা নামাজের মতোই ফরজ বা অলঙ্ঘনীয় বিধান।

যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা সম্পদকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ ও বরকতময় করেন। তাই যাকাত দিতে পারা বা স্রষ্টার যাকাতদাতার তালিকায় নাম লেখাতে পারা একটি বড় মর্যাদার ব্যাপার।

কোয়ান্টাম যাকাত ফান্ড

আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পছন্দ এবং বিধান অনুসারে সঙ্ঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ১৯৯৬ সালে যাকাত ফান্ড গঠন করে। এটিই কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যদের গ্রহণযোগ্য যাকাত দেবার স্থান।

প্রথমে মূলত কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রদেয় যাকাত এ ফান্ডে প্রদান করতে শুরু করেছিলেন। পরে পর্যায়ক্রমে তাদের আত্মীয়-বন্ধুদের যাকাতও তারা সংগ্রহ করে এ ফান্ডে জমা দিতে থাকেন। ফলে যাকাত ফান্ডে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ প্রতি বছরই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে এ ফান্ডে জমা পড়ে ৯ কোটি ২৭ লক্ষ ৮২৪ টাকা।

এখন সবাই উদ্যোগী হলে এটি এক বিশাল ফান্ডে রূপান্তরিত হতে পারে। জমাকৃত অর্থের মাধ্যমে শরীয়ত নির্ধারিত খাতে দুস্থ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আরো বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

তবে কোনো যাকাতদাতা যাকাত বিতরণের মাধ্যমে তার অভাবী পরিচিতকে পুনর্বাসন করতে চাইলে, পুরো অর্থ ফান্ডে জমা দিয়ে কতৃপক্ষের দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে সেবা দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

যাকাত আদায়ের শাশ্বত চেতনা ছড়িয়ে দিন

যাকাত আদায়ে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অবস্থান হলো, একজন মানুষ যেন এই সঙ্ঘের মাধ্যমে স্রষ্টার একটি হুকুম সঠিকভাবে পালন করার পদ্ধতিটি জানতে পারে। সচেতন হয়ে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে জীবনে অফুরন্ত কল্যাণ এবং সম্পদে প্রবৃদ্ধি লাভ করতে পারে।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আহবান জানায়, যাকাত আদায়ের শাশ্বত চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে নিজের সামর্থ্য, সময় ও সুযোগকে কাজে লাগান। নিয়মিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সত্যের বাণী চারপাশে পৌঁছে দিন। নিশ্চিতভাবে স্রষ্টার রহমত ও বরকত লাভ করুন।

উপসংহার

যাকাত কোন ভিক্ষা নয়। যাকাত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়া। এটি ফরজ বা অলঙ্ঘনীয় বিধান। এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠায় বিত্তশালীদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি যারা বিত্তশালী নয় কিন্তু ঈমানদার ও বিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত, তাদেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে।

(হযরত মওলানা ছায়ীদুল হকের যাকাতের উপর একটি আলোচনা অবলম্বনে)