অপরাধবোধ : মুক্তির ৮টি কৌশল

এমন মানুষ নেই যে ভুল করে নি। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে মানুষ ভুল করে, অন্যের অনুভূতিকে আহত করে, অন্যের প্রতি অবিচার করে। অন্যায় বা ভুলের ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় পাপবোধ বা অনুশোচনা। এই পাপবোধ বা অনুশোচনাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে মারাত্মক মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। পাপবোধ আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, আত্মসম্মানবোধকে ধ্বংস করে, জীবনের আনন্দকে মাটি করে দিতে পারে। পাপবোধ সম্পর্ক নষ্ট করা থেকে শুরু করে জটিল রোগ এমনকি ক্যান্সার সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে। অথচ একটু চেষ্টা করেই পাপবোধ বা অনুশোচনাকে আপনি ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন। নিম্নের ৮টি পদক্ষেপ গ্রহণ করে আপনি অনায়াসে আপনার পাপবোধকে ভবিষ্যৎ সাফল্যের ভিত্তিতে রূপান্তরিত করতে পারেন। আপনার পাপবোধ বা অনুশোচনাই হয়ে উঠতে পারে আপনার আত্মনির্মাণের হাতিয়ার।

১. পাপবোধকে সতর্ক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করুন :

যে কোনো পাপবোধ মনে করিয়ে দেয় যে কিছু একটু ভুল হয়ে যাচ্ছে। যখনই পাপবোধ আপনাকে পেছনে ফিরে তাকাতে, নিজের কাজ পর্যালোচনা করতে, নিজের আচরণ পরিবর্তন করতে উদ্বুদ্ধ করে তখন অনুশোচনা আপনার এক নম্বর মিত্রে পরিণত হয়। প্রখ্যাত মার্কিন গায়ক নেইল ডায়মন্ড-এর কথা ধরুন। ১৯৭২ সাল নেইল ডায়মন্ড যখন খ্যাতির শীর্ষে তখন তিনি সঙ্গীত জগৎ থেকে চার বছরের বিরতি নিয়ে নিলেন। কারণ ছিল বিবেকের দংশন। তিনি নিজেকে বললেন, প্রথম বিয়ে তালাক হয়েছে। দ্বিতীয় বিয়েও ভেঙে যাক এটা আমি চাই না। তিনি পুরো ৪৮ মাস কাটালেন নিজেকে নিয়ে, স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে। নেইল ডায়মন্ড এই বিরতির মাধ্যমে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি বোধ করলেন। ৪ বছর পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন প্রশান্ত ও সুখী মানুষ হিসেবে। মঞ্চে তিনি পেলেন আগের চেয়ে অনেক সহজ সাবলীলতা। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি হলেন আগের চেয়ে অমায়িক ভালো মানুষ।

২. পাপবোধের গুরুত্ব অনুভব করুন :

পাপবোধ বা অনুশোচনায় সাড়া দিয়ে একজন মানুষ যখন নিজের ভুল, ক্ষতিকর, আক্রমণাত্মক বিদ্বেষাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আচরণকে সংশোধন করে তখন এই পাপবোধই আত্ম উন্নয়নের সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাই নিজের প্রতি বা মানুষের প্রতি কোনো ভুল বা অন্যায় করলে অবশ্যই অনুশোচনা করা উচিত। অনুশোচনাই মন্দকে ভালোয় রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে।

৩. পাপবোধকে বিশ্লেষণ করুন :

সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করে পাপবোধকে কমানো বা সংশোধন করা যেতে পারে। এমনকি তা পুরোপুরি দূর করা যেতে পারে। কর্মজীবী মহিলা নাসরীন মেয়ে অসুস্থ হলেই পাপবোধে ভুগতেন। তিনি চাকরি করেন। মেয়ের যত্ন ঠিকভাবে নিতে পারেন না তাই মেয়ে অসুস্থ হয়। এই ছিল তার ধারণা। তিনি এ সমস্যার কথা আমাকে জানালে আমি পুরো বিষয়টিকেই বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করে দেখতে বললাম। তিনি দেখলেন চাকরি ছেড়ে দিলে মেয়েকে নিয়ে জীবন ধারণ করার বিকল্প কোনো আয়ের উৎস নেই। তাই চাকরি ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু এটা সম্ভব নয়, তাই এ নিয়ে পাপবোধ ও অনুশোচনা করার কোনো যুক্তি নেই। নাসরীন যেহেতু পাপবোধকে বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন এটি তার ইচ্ছাকৃত কোনো অপরাধ নয়, তাই এই পাপবোধ তার বা তার মেয়ের জীবনে আর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে নি।

৪. যুক্তিসঙ্গত কাজ করুন :

নিজের পাপবোধ বিশ্লেষণ করে সে ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। কিছু করতে পারেন নি বা কোনো ভুল করে ফেলেছেন—এই অপরাধবোধ দূর করার জন্যে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে ক্ষমা চান, ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকলে ভুল সংশোধন করে নিন। অপরাধবোধ যেন আপনাকে এমন কিছু না করায় যা অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়। আমেরিকার ঘটনা এটি। এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তার মৃত ভাইয়ের সমাধি স্তম্ভ বানিয়েছিল, পাথরের তৈরি প্রমাণ সাইজ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির মডেল দিয়ে। দেখলে মনে হবে একটি মার্সিডিজ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভাস্কর একটি মাত্র পাথরের খণ্ড থেকে এক বছর পরিশ্রম করে গাড়ির মডেল তৈরি করে। খরচ পড়ে আমাদের টাকায় ৮০ লক্ষ টাকা। এটি তৈরির কারণ হচ্ছে ভদ্রলোকের ভাই গাড়ির জন্যে আবদার করেছিলেন। ব্যস্ততার কারণে আজ দেই কাল দেই করে কেনা হয় নি। এর মধ্যেই দুর্ঘটনায় ভাই মারা যায়। ভদ্রলোক অনুশোচনায় পড়ে যান। তাই নিজের অপরাধবোধের মাসুল হিসেবে ভাইয়ের কবরের উপর পাথরের মোটরগাড়ি বসিয়ে দেন। এটা এক ধরনের চরম ব্যবস্থা। একে পাগলামিও বলা যায়। এ সব না করে তিনি টাকাটা আর্তমানবতার সেবায় দান করলে মানুষের উপকার হতো আর তার ভাইয়ের আত্মাও শান্তি পেত। আপনার বেলায় কখনও এমন ঘটনা ঘটলে আর্তমানবতার কল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করুন। মৃতের আত্মা শান্তি পাবে।

৫. কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয় :

পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যে ভুল করে নি। তাই কখনও ভুল করে ফেললে ভুল স্বীকার করুন। ক্ষমা চেয়ে নিন। নিজেকে ক্ষমা করে দিন। সবসময় মনে রাখবেন, আপনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন। আপনি ভুল করতে পারেন। তাই ভুল নিয়ে অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় অনুশোচনা করবেন না। ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করার মধ্যে দিয়ে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করুন।

৬. ভুল থেকে শিক্ষা নিন :

একই ভুলের পুনরাবৃত্তি শুধু নির্বোধরাই করে থাকে। বুদ্ধিমানরা সবসময় নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়। ভুলের পুনরাবৃত্তি থেকে বিরত থাকে। তাই একই ভুল বা একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।

৭. তওবা করুন :

কোনো অপরাধ বা পাপ করে ফেললে আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করুন। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করুন। তওবা করুন। আপনার পাপ মোচনের জন্যে করুণাময়ের সাহায্য নিন। আপনি জানেন স্রষ্টা ক্ষমাশীল। ক্ষমা হচ্ছে স্রষ্টার সবচেয়ে বড় গুণ। আপনার যে কোনো পাপকে তিনি ক্ষমা করে দিতে পারেন। তাই আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করুন। তওবা আপনাকে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ ও সম্ভাবনাময় করে তুলবে।

৮. সব ভুলে যান, সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে যাত্রা করুন :

ভুল সংশোধন ও আচরণ পরিবর্তন করার জন্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর পাপবোধ বা অপরাধবোধ মন থেকে নির্বাসিত করুন। ভুলে যান অতীত ভুলকে। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে যান। এই ভুলে যেতে পারাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধবোধকে মন থেকে পুরোপুরি বিদায় করতে পারলেই আপনি কল্যাণময় নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। অপরাধবোধ বা পাপবোধ থেকে নিজের উত্তরণ ঘটানোর জন্যে উপরে উল্লেখিত কৌশল বা পদক্ষেপ অত্যন্ত কার্যকরী। আপনি অনায়াসে এই কৌশল অনুসরণ করে নিজের অনন্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করে এক প্রশান্ত ও মহিমান্বিত জীবনের অধিকারী হতে পারেন।