লজ্জা কাটানোর ৫টি পন্থা

সন্দেহ নেই লজ্জা একটি সুন্দর আবেগ। লজ্জা মানুষকে ক্ষতিকর প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। লজ্জার কারণেই আমরা অশোভন কার্যকলাপ থেকে সাধারণত নিজেদের বিরত রাখি। লজ্জার কারণেই আমরা অনেক সময় লোভনীয় কিন্তু সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য কার্যকলাপ, যেমন চুরি, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি থেকে বিরত থাকি।

লজ্জার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে মুখ কান লাল হয়ে ওঠা। অভিযোগকারীর চোখের দৃষ্টি থেকে নিজের চোখকে নামিয়ে নেয়া, মুখ-কাঁধ নত হয়ে আসা। অর্থাৎ, লজ্জা পেলে আমরা অভিযোগকারীর সামনে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কারো কারো মনে হয় মাটি ফাঁক হয়ে গেলে তার মাঝে হারিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচা যেত। লজ্জা পাওয়ার অর্থ অনেকটা নিজেকে লুকিয়ে ফেলা। আর লজ্জা সবসময় যেহেতু নিজেকে লুকানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকে তাই লজ্জাকে সহজে শনাক্ত করা যায় না।

লজ্জা স্বাভাবিকভাবে হিতকর হলেও এর অতিরিক্ত প্রভাব বা বিকৃত প্রভাব যে-কোনো মানুষের জীবনকে বিড়ম্বিত এমনকি বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। লজ্জা তখন ক্রোধ, একগুঁয়েমি, অহঙ্কার, বিষণ্নতা, মৌনের মুখোশ পরিধান করতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অধিকাংশ বিষণ্নতার ভিত্তি হচ্ছে লজ্জা। আবার হঠাৎ অস্বাভাবিক রাগের বহিঃপ্রকাশও ঘটতে পারে ছোটবেলার কোনো লজ্জাকর ঘটনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে।

লজ্জাকে অনেকে অপরাধবোধের সাথে মিলিয়ে দেখেন। কিন্তু এই দু'য়ের মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমরা করেছি বা করার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছি এমন কোনো কাজের জন্যে খারাপ লাগা হচ্ছে অপরাধবোধ। যেহেতু এটি কাজের সাথে জড়িত তাই অপরাধকে স্বীকার করে নিয়ে, সে ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে। কোনো মন্দ বা খারাপ কাজের সাথে অপরাধবোধ জড়িত। আর লজ্জায় আমরা নিজেদেরই খারাপ মনে করে থাকি। তাই অপরাধবোধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ, কিন্তু লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো ধরনের লজ্জার শিকার হতে পারে। আমরা সাধারণত তিনটি ব্যাপারে লজ্জিত হই : দুর্বলতা, নোংরামি, ত্রুটি। নিজের শরীর নিয়েও লজ্জা থাকতে পারে। যেমন আমি একটু খাবার কমাতে পারলে এ রকম মোটা হতাম না। বা, নাকটা কী বিশ্রী! আমার পা কেমন ছোট আর দুর্বল। আমরা এ ধরনের লজ্জাকে সুপ্ত লজ্জা বলে অভিহিত করতে পারি।

সুপ্ত লজ্জায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবসময় লজ্জা ও গর্বের নাগরদোলায় দুলতে থাকে। সাফল্য এদের সাময়িকভাবে গর্বের পথে নিয়ে যায়, আবার যে কোনো ছোটখাট ব্যর্থতাও এদের মধ্যে লজ্জা ও অক্ষমতার অনুভূতিকে চাঙ্গা করে তোলে। এই সুপ্ত লজ্জার হাত থেকে যত নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, ততই জীবন আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে। সুপ্ত লজ্জার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে নিন্মোক্ত ৫টি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন।

১. শনাক্তকরণের মাধ্যমে লজ্জাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসুন। কোনো মানুষ, স্থান, বিষয় বা কার্যক্রমকে আপনি এড়িয়ে চলেন, তা শনাক্ত করুন। এদের এড়িয়ে চলার পেছনে সুপ্ত লজ্জার কারণগুলো খুজে বের করুন।

২. লজ্জার প্রকৃতি হচ্ছে লুকানো বা পালিয়ে বেড়ানো—তাই একে মোকাবিলা করতে হবে উল্টোভাবে। অর্থাৎ যখন আপনি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলতে যাচ্ছেন, তখন সরাসরি চোখের দিকে তাকান এবং মনে মনে ভাবুন আমার এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই।

৩. ইচ্ছাকৃতভাবে যারা আপনাকে লজ্জাজনিত পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় বলে আপনি মনে করছেন তাদের এড়িয়ে চলুন। তাদের সাথে সম্পর্কের ধরন পাল্টে ফেলুন।

৪. কোয়ান্টাম মেথড অনুসারে লজ্জা বিদূরণের জন্যে আপনি চমৎকার পন্থা অনুসরণ করতে পারেন। শিথিলায়নের সহজ প্রক্রিয়ায় আলফা স্টেশনে পৌছে আপনার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাগুলো এক এক করে হুবহু স্মরণ করুন। লজ্জাজনক ঘটনার পুরো দৃশ্য প্রতিটি খুঁটিনাটিসহ নিজের সামনে নিয়ে আসুন। ঘটনার সাথে জড়িত প্রতিটি রঙ, গন্ধ, স্বাদ ও তাপমাত্রাকে হুবহু অনুভব করার চেষ্টা করুন। পুরো দৃশ্যকে যতদূর সম্ভব হুবহু পুনরাবৃত্তি করুন। শুধু লজ্জাজনক পরিণতির অংশটুকু বাদ দিন। যে ঘটনা থেকে লজ্জার উদ্ভব হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি করার পর একটি নতুন ইতিবাচক দৃশ্য সংযোজন করে দৃশ্যের পরিসমাপ্তি ঘটান। আপনি দেখবেন লজ্জা দূরীভূত হয়ে গেছে। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. গারশেন কাউফম্যান নিরিবিলি বসে ভাবনার মাধ্যমে লজ্জাকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার চমৎকার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় একবার ক্লাসে বক্তৃতা করতে গিয়ে স্টেজে পড়ে যান। এতে ছাত্রদের মধ্যে হাসির রোল ওঠে। তিনি লজ্জা অনুভব করেন এবং এরপর থেকে তার মনে বক্তৃতাভীতি বাসা বাঁধে। পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি এই লজ্জাকে দূর করার জন্যে বেশ কিছুদিন নিরিবিলি বসে পূর্বের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে তা শেষ করতেন ইতিবাচক দৃশ্যের অবতারণা করে। এভাবে তিনি লজ্জাজনক স্মৃতিকে সাফল্যের স্মৃতিতে রূপান্তরিত করেন। বক্তৃতা- যা ছিল এক সময়ে ডা. কাউফম্যানের জন্যে দুঃস্বপ্ন সেটা এক আনন্দের বিষয়ে রূপান্তরিত হয়।

৫. লজ্জার সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক হচ্ছে আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস। নিজেকে সম্মান করতে শুরু করুন। নিজেকে অনন্য সৃষ্টি হিসেবে ভাবুন। কোনো মানুষই দোষক্রুটি মুক্ত নয়। আপনার মাঝেও ত্রুটি থাকতে পারে। সে ত্রুটিকে সহজে মেনে নিন। আর যে গুণগুলো রয়েছে তাকে বিকশিত করুন। আপনার বিকশিত গুণকেই মানুষ তখন সম্মান করবে। আপনারও আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যাবে।