দৃষ্টিভঙ্গি বদলান জীবন বদলে যাবে

published : ১৮ মে ২০১১

গত শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, আমার প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে একজন মানুষ পারে তার জীবনকে বদলে ফেলতে। এ কথার সত্যতা সম্বন্ধে এখন বিজ্ঞানীমহলেও মিলছে সমর্থন। নিউরোসায়েন্টিস্টরা বলেন, মানুষের মস্তিষ্কের রয়েছে যে-কোনো চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা। মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে দশকের পর দশকব্যাপী গবেষণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সাইকোনিউরো-ইমিউনলজি নামে বিজ্ঞানের নতুন শাখা।

এ বিষয়ে ডা. অ্যালেন গোল্ডস্টেইন, ডা. জন মটিল, ডা. ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড ও ডা. ই রয় জন দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়ার আর মন হচ্ছে সফটওয়ার। নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মপ্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়। নতুন বাস্তবতা ভালো হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর হবে তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রাম এর ভালো-মন্দের উপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস ক্ষতিকর বাস্তবতা উপহার দেয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত।

বিজ্ঞানীরা বলেন দৃষ্টিভঙ্গি দু’ধরনের।

১) প্রো-একটিভ। ২) রি-একটিভ।
জীবনকে বদলাতে হলে একজন মানুষকে জানতে হবে রি-একটিভ নয়, প্রো-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করতে হবে।

একজন প্রো-একটিভ মানুষের বৈশিষ্ট্য ৩ টি :

১. তারা উত্তেজিত বা আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত ও প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

২. তারা কি কি নেই তা নিয়ে হা হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করেন।

৩. তারা সাময়িক ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েন না।

নিচের গল্পটি পড়ুন:

বাবা, ছেলে ও গাধার গল্প

বাবা ও ছেলে বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির পোষা গাধাটিকে বিক্রি করার জন্যে হাটের পথে যাত্রা শুরু করল। বাবা, ছেলে ও গাধা তিনজনই হেঁটে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর তাদেরকে দেখে একজন বলল লোক দুটো কি বোকা। গাধা থাকতে হেঁটে যচ্ছে। একজন তো গাধার পিঠে উঠে আরাম করে যেতে পারে। বাবা ছেলেকে গাধার পিঠে উঠিয়ে দিলেন। ছেলে গাধার পিঠে আর বাবা হেঁটে চলছেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকজন বলল, কী বেয়াদব ছেলে। নিজে গাধার পিঠে আরাম করে যাচ্ছে আর বুড়ো বাপকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ মন্তব্য শোনার পর বাবা ও ছেলে স্থান পরিবর্তন করল। বাবা গাধার পিঠে আর ছেলে হেঁটে। আরও কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর আরেক ব্যক্তি মন্তব্য করল, কী নিষ্ঠুর পিতা! নিজে গাধার পিঠে আরাম করছে আর মাসুম বাচ্চাটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ মন্তব্য শোনার পর বাবা ও ছেলে দু’জনই গাধার পিঠে উঠল। গাধা চলতে শুরু করল। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একজন পশুপ্রেমিকের নজরে পড়ল তারা। পশুপ্রেমিক তাদের দেখে আক্ষেপ করে বলতে শুরু করল, কী অত্যাচার! কী অবিচার! একটি গাধা তার উপর দুটি লোক!

বাবা ও ছেলে পড়ল সমস্যায়। কী মুশকিল! গাধার সাথে হেঁটে গেলে দোষ। ছেলে উঠলে দোষ! বাবা উঠলে দোষ! দু’জন উঠলে দোষ! এখন কি করা যায়? বাবা ছেলে দুজন মিলে নতুন এক বুদ্ধি বের করল। বাঁশ ও রশি জোগাড় করল। গাধার চার পা ভালো করে বাঁধল। তারপর পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁশ ঢুকিয়ে দিল। বাবা সামনে আর ছেলে পিছনে বাঁশ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। গাধা রইল ঝুলে। গাধাকে কাঁধে নিয়ে পুল পার হওয়ার সময় গাধা ভয় পেয়ে চিৎকার করে নড়ে উঠল। বাবা, ছেলে ও গাধা পড়ে গেল খালে। গাধার মেরুদণ্ড ভাঙল। বাবা ও ছেলের ভাঙল পা। গাধা আর বেচা হলো না। বাবা ও ছেলে আহত অবস্থায় ফিরে এল ঘরে।

এই বাবা-ছেলে হলেন রি-একটিভ। রি-একটিভ হলে নিয়ন্ত্রণ তখন নিজের হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। আপনি যখন অন্যের কথায় কষ্ট পান, অন্যের কথায় রেগে যান, অন্যের আচরণে ক্রোধে ফেটে পড়েন, অন্যের তোষামোদিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, অন্যের চাটুকারিতায় গলে যান, অন্যের কথায় নাচেন, তখন নিয়ন্ত্রণ আর আপনার হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। গল্পের এ বাবা-ছেলের মতোই রি-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ব্যর্থতা, হতাশা ও অশান্তি সৃষ্টি করে। 

প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে যে-কোনো পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বা আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত ও প্রদক্ষেপ গ্রহণ। প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে অন্যের কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো কাজ বা আচরণ না করা। সর্বাবস্থায় নিজের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আচরণ ও কর্মপন্থা অবলম্বন করা। প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে কি কি নেই তা নিয়ে হা-হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করা। প্রো-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় সাফল্য ও বিজয় ছিনিয়ে আনে।

প্রো-একটিভ মানুষই অন্যকে প্রভাবিত করে, পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে। এই জন্যেই মহামানবরা সবসময় প্রো-একটিভ ছিলেন। নবীজী (স)-র জীবন দেখুন। তিনি সবসময় প্রো-একটিভ ছিলেন। ফলে প্রভাবিত করতে পেরেছেন সবাইকে। 

এক বৃদ্ধা প্রতিদিন নবীজী (স)-র পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত। উদ্দেশ্য নবীজীকে কষ্ট দেয়া। নবীজী (স) প্রতিদিন কাঁটা সরিয়ে পথ চলতেন। যাতে অন্যের পায়ে কাঁটা না বিঁধে। একদিন পথে কাঁটা নেই। দ্বিতীয় দিনও পথে কাঁটা নেই। নবীজী (স) ভাবলেন, একদিন হয়তো ভুল করে বৃদ্ধা কাঁটা বিছায় নি। দুই দিন তো ভুল হতে পারে না। নিশ্চয় বৃদ্ধা অসুস্থ। তিনি খোঁজ নিলেন। বৃদ্ধা ঠিকই গুরুতর অসুস্থ। আমরা হলে হয়তো বলতাম, ‘বেটি বুড়ি আমার পথে কাঁটা বিছিয়েছিস! আল্লাহ তোকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছে।’ কিন্তু নবীজী বৃদ্ধার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করলেন। তার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। বৃদ্ধা সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সুস্থ হওয়ার পর বৃদ্ধার মনে প্রশ্ন জাগল, যাদের কথায় নবীর পথে কাঁটা বিছিয়েছি, তারা তো কেউ আমাকে দেখতে আসে নি। বরং যাকে কষ্ট দেয়ার জন্যে কাঁটা বিছিয়েছি, তিনিই আমার সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন। মানুষ হিসেবে নবীজীই ভালো মানুষ। বৃদ্ধা নবীজীর ধর্ম গ্রহণ করলেন। নবীজী (স) প্রো-একটিভ ছিলেন বলেই বৃদ্ধাকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। বৃদ্ধা যা-ই করুক না কেন, বৃদ্ধার আচরণ দ্বারা নবীজী (স) প্রভাবিত হন নি। নবীজী (স) বৃদ্ধার সাথে সেই আচরণই করেছেন, যা তিনি সঙ্গত মনে করেছেন। সে কারণেই বিরুদ্ধাচরণকারী বৃদ্ধা নবী অনুরাগীতে রূপান্তরিত হলো।

তারা কি কি নেই তা নিয়ে হা হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করেন।

এক ছিল বুড়ি। তার দুটিই মেয়ে। বড় মেয়ের জামাই একজন ছাতা বিক্রেতা। আর ছোট মেয়ের জামাই সেমাই বানিয়ে বিক্রি করে। এই বুড়িকে কেউ কখনো হাসতে দেখে নি। সারাক্ষণই সে শুধু কাঁদত। যখন রোদেলা দিন তখন বড় মেয়ের কথা মনে করে। আর বৃষ্টির দিনে ছোট মেয়ের কথা মনে করে। কারণ রোদ হলে বড় মেয়ের জামাইয়ের ছাতার বিক্রি তেমন ভালো হয় না। আর গ্রীষ্ম ফুরিয়ে বৃষ্টির দিন যখন আসে তখন আবার ছোট মেয়ের জামাইয়ের ব্যবসায় মন্দা যায়। দুই মেয়ের কথা ভেবে রোদ বা বর্ষা কোনোসময়ই তার কোনো সুখ ছিল না।

একদিন এক সাধুর সাথে তার দেখা হলো। সাধু যখন জানতে চাইলেন সে কেন এভাবে সবসময় কাঁদে। সে ঘটনা বলল। সাধু বললেন, এখন থেকে তুমি তোমার চিন্তাটাই বদলে ফেল। রোদের দিন তুমি তোমার বড় মেয়ের কথা ভাববে না। ভাববে ছোট মেয়ের কথা। কত সুন্দর করে সে এই চমৎকার রোদে সেমাই শুকোচ্ছে। আর গ্রীষ্ম শেষে যখন বর্ষা আসবে, ভাববে বড় মেয়ের কথা। যে এখন দেদারসে ছাতা বিক্রি করছে। তখন ছোট মেয়ের কথা মনে করার দরকার নেই।

বুড়ি তাই করল। সমাধানও হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। এখন আর তাকে কাঁদতে হয় না।

২১ বছর বয়সে তিনি ব্যবসায়ে লস করেন। ২২ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে পরাজিত হন। ২৩ বছর বয়সে আবারও ব্যবসায়ে লস করেন। ২৬ বছর বয়সে হারান প্রিয়তমা স্ত্রীকে । ২৭ বছর বয়সে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। ৩৪ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যান। ৪৫ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে হেরে যান। ৩৭ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হলো। ৪৯ বছর বয়সে আবারও সিনেট নির্বাচনে পরাজিত হন। এবং ৫২ বছর বয়সে তিনি হন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। এতগুলো হারের পরও যিনি কখনো ভাবেন নি, রাজনীতি আমার জন্যে নয়। আর তাইতো তিনি হতে পেরেছিলেন আমেরিকার সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্টদের একজন। 

সফল মানুষদের জীবনে বাধা বা প্রতিকূলতা নেই, এ কথাটি ঠিক নয়। বরং তাদের জীবনে বাধা বা সমস্যা সাধারণ মানুষদের চেয়েও বেশি এবং বিচিত্রতর। কিন্তু তাদের তফাৎ হচ্ছে তারা কখনো বাধার মুখে ভেঙে পড়েন না। বাধাটাকে জয় করেন। 

আসলে কোনো পরাজয়ই পরাজয় নয়, যদি তা মানসিকভাবে আপনাকে পরাজিত করতে না পারে। প্রো-একটিভ মানুষেরা এ সত্যটিই উপলব্ধি করেন এবং সাময়িক ব্যর্থতায় ভেঙে না পড়ে কাজ করে যান। ফলে তারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন।

সুতরাং আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকেই শুরু করুন। যা আছে তা নিয়েই শুরু করুন। সাময়িক ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়বেন না। নেতিবাচক লোকদের কথায় প্রভাবিত হবেন না। আপনি জয়ী হবেনই।