published : ১৬ অক্টোবর ২০২৫
মানবদেহের জন্যে প্রয়োজনীয় তিনটি প্রধান ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট হলো কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি) শরীরে লাগে অল্প পরিমাণে। কিন্তু শারীরিক প্রক্রিয়া যেমন শক্তি উৎপাদন, শরীর গঠন, কোষের ক্ষয়পূরণ, বিপাকক্রিয়ায় সহায়তা ইত্যাদি কাজগুলোর জন্যে ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট লাগে বেশি পরিমাণে।
কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং ফ্যাট কতটা গ্রহণ করা প্রয়োজন? কোন উৎস থেকে নিলে তা আপনার জন্যে নিরাপদ হবে? আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবসের এই বিশেষ আর্টিকেলে থাকছে এ-ব্যাপারে কিছু ধারণা।
কিছু কিছু ফুড ব্লগ পড়লে বা কোনো কোনো ডায়েট প্ল্যান দেখলে আপনার মনে হবে এই ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলো বুঝি আপনার শত্রু! তবে বাস্তবতা হলো সুস্বাস্থ্যের জন্যে এগুলো অপরিহার্য।
কার্বোহাইড্রেট শরীরের শক্তির প্রধান উৎস। শর্করা দেহে প্রবেশের পর গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তের সাথে দেহকোষে পৌঁছায়। ব্রেন সেল এবং লোহিত রক্ত কণিকা যথাযথ কাজের জন্যে এই গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল। শরীরের মোট শক্তির ২০ ভাগই ব্রেইন ব্যবহার করে, যা আসে মূলত গ্লুকোজ থেকে। শর্করার অভাবে মনোযোগে ঘাটতি, মাথাব্যথা, মুড সুইং হতে পারে।
কোষ গঠন ও মেরামত এবং এমাইনো এসিডসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উৎপাদনের জন্যে জরুরি প্রোটিন। এটি আমাদের দেহকোষের মূল উপাদান, অংশ নেয় শরীরের গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক কার্যক্রমে। এটি বিশেষভাবে দরকার হয় শারীরিক বৃদ্ধি, বিকাশ এবং টিস্যুর ক্ষয় মেরামতের জন্যে। হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, ৬৪ কেজি ওজনের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা ৫১ গ্রাম।
আর ফ্যাট মানেই খারাপ নয়। মস্তিষ্কের ৬০ ভাগই ফ্যাট দিয়ে গঠিত। শক্তি সঞ্চয়, হরমোন উৎপাদন এবং শরীরে কিছু নির্দিষ্ট ভিটামিন শোষণের জন্যে প্রয়োজন হলো ফ্যাট বা লিপিড। কোষ প্রাচীর গঠন ও সুরক্ষার জন্যে ফ্যাট জরুরি। শারীরিক বৃদ্ধি, প্রজনন ক্ষমতা ও বিপাকক্রিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতেও লাগে ফ্যাট।
কার্বোহাইড্রেট, বিশেষত পরিশোধিত ও চিনিজাতীয় খাবারের শর্করা অতিরিক্ত খেলে ওজন বৃদ্ধি, স্থূলতা, টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হাই ব্লাড সুগার, উচ্চ রক্তচাপ, ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি হয়। এছাড়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, প্রদাহ, দুর্বলতা, পুষ্টি ঘাটতি এবং পরিণামে কয়েক ধরণের ক্যান্সার এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে।
অতিরিক্ত প্রোটিনযুক্ত খাবার খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেসব প্রোটিন ডায়েটে বেশি লাল মাংস এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, সেগুলোর কারণে হৃদরোগ ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। কিডনি জটিলতা, পানিশূন্যতা, ওজন বৃদ্ধি, পুষ্টি ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি হতে পারে অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ থেকে।
প্রক্রিয়াজাত মাংস ও প্রাণিজ খাবারের স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্সফ্যাট ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, মেদস্থূলতা ও ওজন বৃদ্ধি, টাইপ টু ডায়াবেটিস ও কোষ্টকাঠিন্যের ঝুঁকি বাড়ায় মাত্রাতিরিক্ত ফ্যাট।
ভালো-মন্দের ভিত্তিতে পুষ্টিবিদরা শর্করাকে দুটো ভাগে ভাগ করছেন- গুড কার্ব এবং ব্যাড কার্ব।
হোল গ্রেইন বা পূর্ণ শস্য, যেমন অপ্রক্রিয়াজাত চাল, ওটস, গম, বার্লি ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত শর্করা হলো গুড কার্ব। এসব শস্যের তিনটি প্রধান অংশ থাকে-
ব্র্যান (bran) বা খোসা : শস্যের বহিরাবরণ, যেখানে থাকে ডায়েটারি ফাইবার, ভিটামিন বি এবং মিনারেল;
এমব্রায়ো বা জার্ম (germ) : খোসার নিচের অংশ, যেখানে থাকে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, ভিটামিন বি ও ই, প্রোটিনসহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণ;
এন্ডোস্পার্ম (endosperm) : শস্যের শ্বেতসারবহুল মাঝের অংশ, যাতে থাকে মূলত কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিন।
প্রক্রিয়াকরণের অংশ হিসেবে যখন এই শস্যগুলোর বাইরের অংশ ছেটে ফেলা হয় তখন অন্যান্য পুষ্টিগুণের সাথে সাথে এরা হারায় গুড কার্ব। বাকি যা থাকে একেই পুষ্টিবিদরা বলছেন ব্যাড কার্ব।
যেমন লাল চাল ও লাল আটা যদি আপনি খান তাহলে এর গুড কার্ব আপনার শর্করার চাহিদা তো মেটাবেই, উপকার করবে দেহের। কিন্তু সাদা চালের ক্ষেত্রে ধানের খোসার নিচের লাল আবরণসহ চালের প্রথম অংশটুকু ছেটে বাদ দেয়ায় প্রয়োজনীয় শর্করার জন্যে আপনাকে ভাত খেতে হচ্ছে বেশি, কিন্তু পুষ্টি পাচ্ছেন কম। উপরন্তু এসবের মাধ্যমে শরীরে বেশি বেশি ঢুকছে ব্যাড কার্ব।
আবার বিস্কুট, চানাচুর, ফাস্ট ফুড ইত্যাদিতে থাকা শর্করা অতিপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিণত হয় ব্যাড কার্বে। সুস্বাস্থ্যের জন্যে বাদ দিতে হবে এসব ক্ষতিকর শর্করাজাতীয় খাবার।
প্রোটিন ও ফ্যাট গ্রহণ প্রয়োজনীয়; তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এগুলো কোন উৎস থেকে আসছে। এগুলো আপনার জন্যে উপকারী হবে যদি তা হয় প্ল্যান্ট বেইজড বা উদ্ভিজ্জ। মাছ, মাংস, ডিমের চেয়ে মটরশুঁটি, ডাল, বাদাম, বীজ, সয়াবিনের প্রোটিন এবং মাংসের তেলচর্বি, মাখন, ঘির চেয়ে এভোকাডো, জলপাই, বাদাম, বীজের ফ্যাট বেশি নিরাপদ।
মাছ মাংস ডিম খাবেন না, তা না। মাছ, বিশেষত সামুদ্রিক মাছে থাকে দেহের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ওমেগা-৩। তবে প্রাণীজ প্রোটিন সপ্তাহে ১ দিন, আর বাকি ৬ দিন যদি উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ও ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার খান তাহলে এই প্রোটিন ও ফ্যাট থেকে আপনি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পাবেন সর্বোচ্চ উপকার।