ডায়াবেটিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষ, এমনকি অনেক চিকিৎসকের মধ্যে প্রচলিত ধারণা হলো এটি বংশগত ব্যাধি এবং নিরাময়-অযোগ্য। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ সত্য হলো, টাইপ-২ ডায়াবেটিস একটি ভুল লাইফস্টাইল বা জীবনাচারজনিত রোগ, যা থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব।
সম্প্রতি টাইম ম্যাগাজিনের একটি কভার স্টোরিতে বলা হয়েছে- মানুষ চাইলেই তার ডিএনএতে প্রবহমান তথ্যকে বদলাতে পারে। ডিএনএ’র একটি অংশ হলো জিন, যা প্রোটিন মলিকুল তৈরি করে। জিনের ভেতরে এপিজেনম নামে ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল রয়েছে, যেখানে মানুষের চিন্তা কাজ ইত্যাদি প্রোগ্রামিং আকারে লিপিবদ্ধ হয়।
ধরা যাক, একজন ব্যক্তি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, পরিশ্রমবিমুখ, ধূমপায়ী, তৈলাক্ত চর্বিদার ভাজাপোড়া খাবারে আসক্ত এবং যথারীতি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী। এই সবকিছু প্রোগ্রামিং আকারে লিপিবদ্ধ রয়েছে এপিজেনমে। ফলাফল- জিনের মধ্য দিয়ে সন্তানের মধ্যে ডায়াবেটিস। কিন্তু এটাই কি নিয়তি? উত্তর হলো- না!
বাবা বা মায়ের ডায়াবেটিস আছে- এমন কেউ চাইলে ধুমপান বর্জন, অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার, পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম, নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা করে বাড়তি ওজন ঝরিয়ে শরীরকে ফিট করে এপিজেনমের পূর্বের প্রোগ্রামিং বদলে ফেলতে পারেন। এতে জিনের আউটপুট বদলে যাবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হবেন ডায়াবেটিসমুক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. নীল বার্নাড তার 'প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং ডায়াবেটিস’ বইয়ে ডায়াবেটিস নিরাময়ে হোল ফুডস প্ল্যান্ট বেইজড ডায়েট বা উদ্ভিজ্জ খাবার অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। একই কথা বলেছেন গবেষক ড. জোয়েল ফরম্যান তার একটি গবেষণাপত্রে।
অর্থাৎ, মাছ মাংস ডিম দুধ, সাদা চাল, চিনি, ময়দা, প্যাকেটজাত-প্রক্রিয়াজাত খাবার, সফট ড্রিংকস, ভোজ্য তেল যেমন পরিহার করতে হবে। তেমনি পুরোপুরি বর্জন করতে হবে তৈলাক্ত এবং চর্বিযুক্ত খাদ্য।
একটু খুঁজলে হাতের কাছেই আপনি পাবেন এমন কিছু প্রাকৃতিক খাদ্য বা উপাদান যেগুলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিরাময়কে ত্বরান্বিত করে। যেমন-
১. জামের বিচিঃ প্রতিদিন এক চামচ জামের বিচি গুঁড়ো খান নাস্তা ও রাতের খাবারের আগে।
২. হার্বাল চাঃ দিনের যে-কোনো সময় পান করুন এক চামচ দারুচিনি গুঁড়ো দিয়ে হার্বাল চা।
৩. মেথিঃ এক চামচ মেথি গুঁড়ো কিংবা গোটা মেথি সারারাত ভিজিয়ে রেখে সেই পানি সকালে খালি পেটে পান করুন।
৪. করলা জুসঃ এক গ্লাস কাঁচা করলা জুস পান করুন সকালে বা দুপুরে খালি পেটে।
৫. ঢেঁড়স-পানিঃ দুই-তিনটে ঢেঁড়স ছোট টুকরো করে রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি পান করুন খালি পেটে।
৬. অ্যাপেল সাইডার ভিনেগারঃ প্রতিরাতে ৩/৪ চা চামচ অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে পান করুন। তবে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ থাকলে অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার পান করবেন না। এতে আচমকা ব্লাড প্রেশার কমে যেতে পারে।
৭. গ্রিন টিঃ দিনে ৩/৪ বার গ্রিন টি পান শুধু ডায়াবেটিসই না, প্রতিরোধ করতে পারে ক্যান্সারও।
প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট হাঁটুন জোরে- ঘন্টায় অন্তত চার মাইল বেগে। পাশাপাশি ২০ মিনিট ইয়োগা ও ১০ মিনিট জগিং- মোটমাট আধঘন্টা। পালন করুন কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, যেমন- বেশিক্ষণ শুয়েবসে না থেকে হাঁটাচলা করা, হেঁটে যাওয়া যায় এমন পথ রিকশা বা গাড়ি নয়, হেঁটেই যান। লিফটের বদলে ব্যবহার করুন সিঁড়ি। শারীরিকভাবে যত তৎপর থাকবেন ডায়াবেটিসসহ বিবিধ রোগের ঝুঁকি তত কমবে।
শুধু শীতকালেই নয়, বছরের অন্যান্য সময়ও গায়ে লাগান সকালের নরম রোদ ১৫/২০ মিনিট। এতে বাড়বে ভিটামিন ডি লেভেল।
পাশাপাশি নিয়মিত করুন মেডিটেশন চর্চা। এতে মানসিক চাপ দূর হবে, ইমিউন সিস্টেম উজ্জীবিত হবে। ফলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাময় হবে সহজ।
ডায়াবেটিসের অন্যতম মূল কারণ হলো দেহকোষে চর্বি হিসেবে জমে থাকা টক্সিন। সপ্তাহে ২/৩ দিন রোজা এই টক্সিনগুলোকে ধ্বংস করে। এছাড়াও বাড়ায় মেটাবলিজম ও দেহকোষের ইনসুলিন ব্যবহার করার ক্ষমতা।
এমনকি সাম্প্রতিক গবেষণায় এও দেখা গেছে, সপ্তাহে তিনদিন ২৪ ঘন্টার ফাস্টিং ইনসুলিন রেজিস্টেন্স সম্পূর্ণ সারিয়ে দিতে সক্ষম!
তাই ডায়াবেটিস নিয়ে নয় অহেতুক আতংক। সচেতনতা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দিয়ে আপনি পারেন ডায়াবেটিসমুক্ত সুস্থ জীবনের অধিকারী হতে।