published : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
Walking is the best medicine. আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস এ কথাটি বলেছিলেন আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। কথাটি আজও একইরকম সত্য। বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য-গবেষকদের মতামত তা-ই বলছে।
হাঁটার উপকারিতা বিস্তর। নিয়মিত হাঁটেন যারা, তাদের হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকে। কারণ, হাঁটার ফলে হৎপিণ্ড ও ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বাড়ে। আর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের মতো জীবনঘাতী রোগগুলো প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত হাঁটার ভূমিকা এখন একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। শুধু শারীরিক সুস্থতার জন্যেই নয়, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখারও চমৎকার একটি উপায় হলো হাঁটা।
প্রায় ৪০ হাজার নারী-পুরুষের ওপর পরিচালিত একটি ব্যাপক আকারের গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাসটি যাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ, তারা তুলনামূলক কম অসুস্থতায় ভোগেন। তাদের ওষুধের প্রয়োজনও হয় কম। এছাড়াও হাঁটার ফলে দেহের অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা বাড়ে। ফলে শরীর-মন সবসময়ই থাকে প্রাণবন্ত।
নিয়মিত হাঁটুন। আপনার হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্যে এটি বিশেষভাবে উপকারী। যারা সপ্তাহে তিন ঘণ্টা দ্রুতগতিতে হাঁটেন, তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে অনেকখানি। সেইসাথে কমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। হৃৎপিণ্ড থাকে সুস্থ সবল ও অধিকতর কর্মক্ষম।
রক্তে কোলেস্টেরল-মাত্রার তারতম্য করোনারি হৃদরোগের অন্যতম কারণ। এখানে উল্লেখ্য, হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্যে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল-এর পরিমাণ থাকা চাই পরিমিত আর উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএল-এর পরিমাণ থাকা উচিত নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে বেশি। নিয়মিত হাঁটলে ঠিক তা-ই ঘটে। অর্থাৎ এলডিএল-এর পরিমাণ কমে এবং বাড়ে এইচডিএল-এর পরিমাণ। হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্যে এটি জরুরি।
এছাড়াও নিয়মিত হাঁটলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। উল্লেখ্য, অতিরিক্ত ওজন বা মেদস্থূলতা করোনারি হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
নিয়মিত হাঁটেন যারা, তাদের হৃৎপিণ্ডের চারপাশে কোলেটারাল সারকুলেশন গড়ে ওঠে। সেটা কেমন? আমরা অনেক সময় শুনি, এনজিওগ্রাম করে দেখা গেছে, কারো একটি বা দুটি করোনারি ধমনীতেই রক্ত চলাচল শতভাগ বন্ধ অর্থাৎ ১০০% ব্লকেজ। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক-তবে তিনি বেঁচে আছেন কী করে? রক্তনালী শতভাগ বন্ধ হয়ে পড়লে তো হৃৎপিণ্ডের কোষ আর পেশিগুলো প্রয়োজনীয় রক্ত ও পুষ্টির অভাবে পুরোপুরি অকেজো এমনকি মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না কেন?
এখানে যে বিষয়টি ঘটে তা হলো, হৃৎপিণ্ডের ব্লকেজ-আক্রান্ত ধমনীর চারপাশে কিছু পরিপূরক রক্তনালী সচল হয়ে ওঠার মাধ্যমে একটি কোলেটারাল সারকুলেশন গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনীর চারপাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালী থাকে-যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, ব্যায়াম করেন, বিশেষ করে যারা নিয়মিত হাঁটেন, তাদের এই রক্তনালীগুলো সচল হয়ে ওঠে। মূলত এই বিকল্প রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমেই হৃৎপিণ্ডের সব অংশে প্রয়োজনীয় রক্ত পৌঁছে যায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালীর সংখ্যা কারো কারো ক্ষেত্রে দুশ থেকে আড়াইশটি পর্যন্ত হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘ন্যাচারাল বাইপাস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
করোনারি হৃদরোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসেবে বর্তমানে দেশে-বিদেশে ‘ইসিপি’ নামে একটি চিকিৎসাপদ্ধতির প্রচলন ঘটেছে। যার মূল উদ্দেশ্য প্রধানত এটাই-কোলেটারাল সারকুলেশন তৈরি করা। আর এ উপকারটিই আপনি বিনা অর্থ ব্যয়ে চমৎকারভাবে লাভ করতে পারেন নিয়মিত ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা হাঁটা এবং ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে। হাঁটার ফলে একদিকে আপনার ন্যাচারাল বাইপাসের সম্ভাবনা বাড়লো, এর পাশাপাশি হাঁটার অন্যান্য উপকারিতাগুলোও আপনি লাভ করলেন।
নিয়মিত হাঁটলে আপনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন। পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে যাদের, তারা বেশ দুশ্চিন্তায় ভোগেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাড়া করে ফেরে তাদের। প্রায়ই ভাবেন, এ থেকে বুঝি আর মুক্তি নেই। গবেষকরা বলছেন, মুক্তির উপায় আছে বৈকি। সেটি হলো, সপ্তাহে অন্তত চার/ পাঁচ দিন জোরে হাঁটুন। ইংল্যান্ডে পরিচালিত একটি গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে।
আবার, ইতোমধ্যেই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন যদি, তবে প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা আপনার জন্যে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে হাঁটা অত্যন্ত কার্যকরী। তাতে এসব রোগ থেকে সৃষ্ট নানান জটিলতা আপনি খুব সহজেই এড়াতে পারবেন। আর সে কারণেই এসব অসুখ শনাক্ত হলে চিকিৎসকরা ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দেন।
হাঁটলে ক্যান্সার-ঝুঁকি কমে। একাধিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, নিয়মিত হাঁটার ফলে কোলন ক্যান্সার এবং বিশেষত মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। এমনকি ক্যান্সার-আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা নিয়মিত হাঁটেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক কম।
হাঁটার ফলে হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস-এর ঝুঁকি কমে। এ-ছাড়াও নিয়মিত হাঁটার ফলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হয়ে ওঠে আরো সংহত ও কার্যকরী।
নিয়মিত হাঁটার একটি উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো, এর ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালী ও নিউরোনগুলোতে রক্তপ্রবাহ বাড়ে। মস্তিষ্কের সব নিউরোন, সিন্যাপ্স কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে অধিকতর সক্রিয় ও প্রাণবন্ত।
নিয়মিত হাঁটেন যারা, তাদের দেহ-মনে সৃষ্টি হয় এক চনমনে সুখানুভূতি। কারণ, এতে স্ট্রেস-এর পরিমাণ কমে। গবেষকরা বলছেন, এসব মানুষ তুলনামূলক দুশ্চিন্তামুক্ত, হাসিখুশি, তারুণ্যদীপ্ত ও ইতিবাচক মনোভাবে উজ্জীবিত। নিয়মিত হাঁটার ফলে বয়সজনিত স্মৃতিভ্রম রোগ আলঝেইমার্স-এর ঝুঁকি কমে অনেকখানি।
হাঁটা বিষণ্নতা প্রতিরোধ ও নিরাময় করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, গুরুতর বিষণ্নতায় ভুগছিলেন এমন রোগীদের মধ্যে একদলকে নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। টানা ১২ সপ্তাহ এভাবে চলার পর দেখা গেছে, তাদের বিষণ্নতার হার কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। বিজ্ঞানীদের মতে, হাঁটা সত্যিই সুখকর। আর হাঁটার সাথে রাতের সুখনিদ্রার সম্পর্কটাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, হাঁটা আপনার দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ায়। আপনাকে সুস্থ রাখে। তাই নিয়মিত হাঁটুন। সকালে বা বিকেলে আপনার সুবিধামতো যেকোনো সময়ে হাঁটতে পারেন। একে দৈনন্দিন রুটিনের একটি আনন্দময় অনুষঙ্গে পরিণত করুন। সুস্থতার আনন্দ নিয়ে হাঁটুন।
দেহ-মনের সুস্থতার জন্যে চাই জোর কদমে হাঁটা। ঘণ্টায় চার মাইল বেগে। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট। এভাবে না পারলে ধীরে হাঁটুন এবং দিনে ১৫/২০ মিনিট করে শুরু করুন। প্রতিদিনই একটু একটু করে হাঁটার গতি ও সময় বাড়ান।
হাঁটার আদ্যোপান্ত জানলেন। সত্যতা নিজেই পরখ করে দেখুন। বেরিয়ে পড়ুন হাঁটতে...।
তথ্যসূত্র : ডা. ডিন অরনিশের ‘প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ’ ও ‘স্পেকট্রাম’
টাইমস অব ইন্ডিয়া (১৯ অক্টোবর, ২০১৩)
ডিসকভারি হেলথ অনলাইন