রোজা ও অটোফেজি-প্রাকৃতিক এক নিরাময় প্রক্রিয়া

published : ১৫ এপ্রিল ২০১৯

অটোফেজি। একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ায় দেহের ক্ষয়িষ্ণু এবং অপ্রয়োজনীয় কোষাণুগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়। আসলে এ হলো কোষের এক আবর্জনা পরিচ্ছন্নকরণ প্রক্রিয়া! কোষের কার্যক্ষমতাকে ঠিক রাখতে যে প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর দেহ যখন বিশেষ সংকটাবস্থায় থাকে, তখন এই অটোফেজিই দেহকে বাঁচিয়ে রাখে!

২০১৬ এর নোবেল পায় ‘অটোফেজি’ গবেষণা

অটোফেজি বিজ্ঞানের অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একটি পরিভাষা। ২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওশুমি অটোফেজি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পাবার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়! একদিকে ড্রাগ কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় লেগে যায় যাতে এমন একটা ওষুধ তারা আবিষ্কার করতে পারে যা অটোফেজিকে ত্বরান্বিত করবে। অন্যদিকে ফিটনেস ও ডায়েট বিশেষজ্ঞরা বলতে থাকেন- রোজা রেখে, ভারী ব্যায়াম করে ও শর্করাজাতীয় খাবার কম খেয়ে অটোফেজিকে ত্বরান্বিত করা যায়।

কী ঘটে অটোফেজিতে?

ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক। কোষের স্তরে এটাকে বলে ‘এটোপিক ওজন ০:৫৮’। এবার একে আপনি কল্পনা করুন, রাস্তার একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সাথে। যার কাজ হলো সারাদিন ধরে শহরবাসীরা রাস্তায় যত আবর্জনা ফেলেছে, তা ঝাঁট দিয়ে দিয়ে একসাথে জড়ো করা। তারপর ময়লা টানা গাড়িতে করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসা।

‘এটোপিক ওজন ০:৫৮’ ঠিক এই কাজটাই করে। কোষের আবর্জনা, ক্ষয় হয়ে যাওয়া কোষাণু – ইত্যাদিকে সংগ্রহ করে  লাইসোজম নামে এক অংশের সাথে এটি সম্পৃক্ত হয়। লাইসোজমের সাথে মিশে গিয়ে তৈরি করে নতুন কোষাণু। অর্থাৎ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুরনো জিনিস দিয়ে যেমন নতুন জিনিস হয়, অটোফেজিও তেমনি ভাঙাচোরা কোষাণুকে রূপান্তরিত করে নতুন কোষাণু ও শক্তিতে।

রোজা রাখলে কি অটোফেজি সক্রিয় হয়?

এবার আসা যাক রোজা বা উপবাসে কী হয়? দেহের জন্যে এটাকে একটা বিশেষ অবস্থা বলা যেতে পারে, কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাইরে থেকে দেহে কোনো খাবার বা পানীয় আসছে না। দেহের যেসব অবস্থায় অটোফেজি সক্রিয় হয়ে ওঠে, এটা তার একটা! অটোফেজির কারণেই সেসময় দেহ সচল থাকে। কারণ একটু আগেই যেমনটা বলা হলো- কোষের আবর্জনা, জীবাণু ইত্যাদিকে ভেঙে ফেলে রিসাইক্লিংয়ের মধ্য দিয়ে অটোফেজি প্রক্রিয়াই তখন দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে । অর্থাৎ বাইরের রসদের ওপর নির্ভর না করে দেহ তখন নিজেই নিজের রসদ দিয়ে নিজেকে চালায়।

অটোফেজির উপকার

১. প্রদাহ (ব্যথা, লাল হওয়া, ফুলে যাওয়া এবং সংক্রমণ) কমে যাওয়া

রোগের একটা বড় কারণই প্রদাহ। ক্যান্সার, হৃদরোগ বা অন্যান্য ক্রনিক রোগের মূল কারণের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব- দেহে যখন স্থায়ীভাবে দীর্ঘসময় ধরে এ জাতীয় প্রদাহ বিরাজ করে, তখনই তা এসব রোগের রূপ নেয়। কাজেই প্রদাহ যদি কমে যায়, তাহলে রোগবালাইও হবে না!

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

এ নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন ডা. লোঙ্গো। সে গবেষণায় তিনি দেখান যে, কেউ যদি একটানা চারদিন উপবাস করে (পানি ছাড়া অন্য আর কিছু না খাওয়া), তাহলে তার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাটাই পুরো নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার, কারণ বহু মানুষ আছে যারা শুধু রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ভুগছে।

৩. বার্ধক্য প্রতিরোধ

অটোফেজির কারণে ত্বক বার্ধক্যের প্রভাবমুক্ত হয় এবং ত্বককে দেখায় স্বাস্থ্যজ্জ্বল। ত্বকের ভাঁজ নিয়ে আমরা অনেক সময় দুঃশ্চিন্তা করি। বিশেষ করে ওজন কমানোর একটা সমস্যা হলো ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। কিন্তু অটোফেজিকে সক্রিয় হতে দিলে এই ভাঁজের সমস্যা দূর করা সম্ভব। 

৪. ক্ষুরধার মস্তিষ্ক

সক্রিয় অটোফেজি ব্যবস্থা আপনার মস্তিষ্ককে ক্ষুরধার হতেও সাহায্য করে। এমনকি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়- আলঝেইমার বা পার্কিনসন্স জাতীয় বয়সজনিত রোগগুলো যে কারণে হয়, তার প্রতিরোধও করে অটোফেজি।

৫. জীবাণু ধ্বংস

প্যাথোজেন, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি জীবাণুকে ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে অটোফেজি

৬. দীর্ঘ জীবন

আর এসবকিছুর মিলিত ফল হলো আপনার দীর্ঘজীবন। মানে আপনার যদি প্রদাহ কমে যায়, ক্যান্সার, হৃদরোগ না হয় তাহলে আপনার সুস্থ দীর্ঘজীবন হবে সেটাই স্বাভাবিক না?

৭. অটোফেজি ও ক্যান্সার

ক্যান্সার নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন এমন একজন বিজ্ঞানী টমাস সেফ্রেইড। প্রাকৃতিকভাবে ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়েই তার গবেষণা। তিনি দেখেন, বছরে কেউ যদি অন্তত একবারও সাত দিন একটানা উপবাসে থাকতে পারে (পানি ছাড়া অন্যকিছু না খেয়ে), দেহ পরিচ্ছন্ন হবার জন্যে তার আর কিছুই লাগে না। ভবিষ্যতে ক্যান্সার ঘটাতে পারে এমন সেলগুলো এ প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি এটা সাত দিন না হয়ে চারদিনও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বছরে কয়েকবার উপবাস করতে হবে।  

রোজা রাখার ১৩-১৮ তম ঘণ্টায় সক্রিয় হয় অটোফেজি

সাধারণভাবে উপবাসের ১৮ তম ঘণ্টা থেকে অটোফেজি সক্রিয় হয়। কোনো কোনো গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে যে, ১৩ তম ঘণ্টা থেকেও অটোফেজি সক্রিয় হয়েছে। কাজেই আমরা বলতে পারি যে, উপবাসের ১৩ তম থেকে ১৮ তম ঘণ্টায় গিয়ে আমাদের দেহে অটোফেজি প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়। সক্রিয় হয় তখন কোষের আবর্জনা ও ক্ষয়ে যাওয়া কোষ রিসাইক্লিং এবং নতুন কোষাণু তৈরি ও শক্তি উৎপাদন।