হার্ট অ্যাটাক : কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়

  • বৈশ্বিক মৃত্যুর ১৯.২ শতাংশের কারণ হার্ট অ্যাটাক
  • হৃদরোগের প্রধার কারণ মানসিক
  • হার্ট অ্যাটাকে চিকিৎসা পেতে এক ঘণ্টা দেরির জন্যে মৃত্যুর হার বেড়ে যায় ১০%
  • হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতা ৮০% ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য; প্রয়োজন শুদ্ধ খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনাচার

সারা বিশ্বে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার এক তৃতীয়াংশের জন্যে দায়ী হৃদরোগ; শুধু হার্ট অ্যাটাকেই ঘটে প্রায় এক পঞ্চমাংশ মৃত্যু। বাংলাদেশেও মৃত্যুর প্রধানতম কারণ এটি। গত বছর হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে ১,৮০,৪০৮ জন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ২১ শতাংশ।

হার্ট অ্যাটাক কী?

আমাদের দেহকোষের প্রধান খাবার হচ্ছে অক্সিজেন। নিঃশ্বাসের সাথে গৃহীত অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে কোষে কোষে পৌঁছে যায়।

আমাদের হৃদপিণ্ডে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তা আসে ধমনী দিয়ে। কিন্তু কোনো কারণে ধমনীর নালী সরু বা পুরু (আর্টারি ব্লকেজ) হয়ে গেলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কখনো কখনো আচমকা রক্ত জমাট বেঁধে নালীর ভেতরে রক্ত প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এটাই হলো হার্ট অ্যাটাক।

আর্টারি ব্লকেজ হতে পারে নানা কারণে

প্রধান কারণ হলো ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরল ও চর্বি জমাট বাধা। এ-ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, আর্থ্রাইটিস বা লুপাসজনিত প্রদাহ ও মেদস্থুলতার কারণেও আর্টারি ব্লকেজ হতে পারে।

তবে হৃদরোগের প্রধার কারণ মানসিক- দীর্ঘ গবেষণার আলোকে বলছেন মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন। এগুলোর মধ্যে আছে ক্রনিক স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, টেনশন, অনিয়ন্ত্রিত রাগ ইত্যাদি।

যে কারণগুলোকে আমরা সাধারণত হৃদরোগের সাথে মেলাই না-

. দাঁতের ফাঁকাগুলো পরিষ্কার না রাখা

বলবেন এ আবার কেমন কথা! দাঁত পরিষ্কার রাখার সাথে হৃদরোগের কী সম্পর্ক?

আসলে বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মুখের স্বাস্থ্যের প্রতি কম যত্নবান লোকজনের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। রক্তপাত হয় বা ক্ষত রয়েছে এমন মাড়ি থেকে মুখের ব্যাকটেরিয়া রক্তে প্রবেশ করে রক্তনালী বা ধমনিতে চর্বির স্তর তৈরিতে সহায়তা করে। এতে তৈরি হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

. বসের প্রতি বিদ্বেষ

রসিকতা নয়, আসলেই অফিসে বসের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ হৃদরোগের কারণ হতে পারে। ১০ বছর ধরে পরিচালিত একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে যে, কর্মক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়!

. দুঃখজনক ঘটনা

পরিবারের কোন সদস্যের মৃত্যুর মতো হঠাৎ কোনো দুঃখজনক ঘটনা সত্যিকার অর্থেই আপনার হৃদয় ভেঙে দিতে পারে।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জ্যাকি ইওবানি বলছেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে অ্যাড্রিনাল থেকে নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। যা হৃৎপিণ্ডে কম্পন বাড়িয়ে তোলে এবং রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয়।

. একাকিত্ব বোধ

একটি ব্রিটিশ জার্নাল বলছে যে, সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চেয়ে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের হৃদরোগের সম্ভাবনা বেশি।

২০১৪ সালে প্রকাশিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ লাখ মানুষের ওপর ৮ বছর ধরে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে নারীরা একা থাকেন,তাদের তুলনায় যারা সঙ্গীর সঙ্গে থাকেন, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ২৮ শতাংশ কম।

৫. বিষণ্ণতা

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ৩৩ শতাংশই বিষণ্ণতায় ভুগেছেন। বিষণ্ন লোকেরা অনেক সময় এমন সব বিপজ্জনক খাদ্যাভ্যাসে জড়িয়ে মানসিকভাবে ভালো থাকতে চান যা আদপে তাদের হৃদস্বাস্থ্যেরই বারোটা বাজায়।

প্রাথমিক উপসর্গ

১. বুকে চাপ চাপ ব্যথা, বুকের একপাশে বা পুরো বুকজুড়ে ভারী ব্যথা

২. শরীরের অন্য অংশে ব্যথা। মনে হতে পারে ব্যথা শরীরের এক অংশ থেকে অন্য অংশে চলে যাচ্ছে। যেমন বুক থেকে হাতে ব্যথা হতে পারে। সাধারণত বাম হাতে ব্যথা হয়, কিন্তু দু হাতেই ব্যথা হতে পারে।

৩. মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করা

৪. ঘাম হওয়া

৫. নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা

৬. বমি ভাব হওয়া

৭. বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগা

৮. সর্দি বা কাশি হওয়া

হার্ট অ্যাটাক হলে যা করবেন

  • আপনি যদি মনে করেন আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। কারো মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখলে তাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যান। ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, চিকিৎসা পেতে এক ঘণ্টা দেরির জন্যে মৃত্যুর হার বেড়ে যায় ১০ শতাংশ;
  • আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কৃত্রিমভাবে তার শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর চেষ্টা করুন;
  • তার যদি বমি আসে তাহলে তাকে একদিকে কাত করে দিন যাতে সে সহজেই বমি করতে পারে। এতে ফুসফুসের মতো অঙ্গে বমি ঢুকে পড়া থেকে তিনি রক্ষা পাবেন।

তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই সব সময় উত্তম

বিশেষজ্ঞদের মতে, হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতা শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। এ-ক্ষেত্রে আপনি যা যা করতে পারেন-

১. চর্বি ও ট্রান্সফ্যাট পরিহার করুন

হৃদরোগের একটি বড় কারণ চর্বি ও ট্রান্সফ্যাট।

তেল বারবার পোড়ালে তা থেকে অক্সিজেন চলে যায় ও তাতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। এই তেলে ভাজলে খাবার মচমচে হয় বটে, তবে তা খেলে শরীরে ট্রান্সফ্যাট জমে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

বিএসএমএমইউ-এর হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হিমেল সাহা বলেন, "বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভাজা-পোড়া (পুরি, সিঙ্গাড়া, সমুচা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, জিলাপি ইত্যাদি), বিস্কুট, চানাচুর, চিপস বা এ ধরণের অসংখ্য অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা আছে। এটাই ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগের কারণ"।

তাই হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে এই খাবারগুলো বর্জন করুন।

২. বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার অনুসরণ করুন

চিনি ও কেক পেস্ট্রি পুডিং আইসক্রিমের মতো চিনিসমৃদ্ধ খাবার পুরোপুরি বর্জন করুন। ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, বেশি কোলস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার রাখুন বর্জনীয়ের তালিকায়।

শিম, বাদাম, মাশরুম, গাজর, মিষ্টি আলু, সামুদ্রিক মাছ, টকদই, স্পিরুলিনা হলো হৃদবান্ধব খাবার। এগুলো রাখুন প্রতিদিনের খাবারের তালিকায়। প্রাণীজ আমিষের চেয়ে বেশি খান উদ্ভিজ্জ আমিষ।

অন্যদিকে শরীরে অতিরিক্ত ওজন ও মেদ থাকলে তা ঝরিয়ে ফেলুন।

৩. ধূমপান বর্জন করুন

হৃদরোগের বড় একটি কারণ হলো ধূমপান। হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে আপনাকে তাই ধূমপান ছাড়তে হবে।

আরো পড়ুন :-

৪. লবণকে বিদায় জানান

ল্যান্সেট ম্যাগাজিনে দ্যা গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিস স্টাডির এক সূত্র ধরে বলা হয়- একজন মানুষের প্রতিদিন ৩.২ গ্রাম বা চা চামচের আধচামচ পরিমাণের চেয়ে বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু সে খাচ্ছে ৬ গ্রামেরও বেশি।

লবণ বেশি খেলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এর ফলে বাড়ে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি।

৫. সপ্তাহে অন্তত চার দিন যোগব্যায়াম করুন

বলবেন ব্যায়াম তো প্রতিদিনই করা উচিত, শুধু ৪ দিন কেন!

যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব এক্সারসাইজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল মেডিসিনের একটি গবেষণামতে, সপ্তাহে অন্তত চারদিনও যদি কেউ শরীরচর্চা করে তাহলে তার হৃৎপিণ্ড হয়ে উঠতে পারে সতেজ-সবল। ষাটোর্ধ ১০০ জনের ওপর চালানো গবেষণাটির পরিচালকদের মতে, যে-কোনো ধরনের শরীরচর্চা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।

কাজেই জীবনের শত ব্যাস্ততার মধ্যেও চেষ্টা করুন নিয়মিত ২০-৩০ মিনিট যোগব্যায়াম করতে। হৃৎপিণ্ডের সুস্থতায় সব যোগাসনই ভালো; তবে এ-ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী হলো ক্যামেল পোজ বা উষ্ট্রাসন।

৬. নিয়মিত মেডিটেশন

বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন যে, আপনি যদি সুস্থ কর্মময় দীর্ঘজীবনের অধিকারী হতে চান তাহলে আপনাকে লাইফস্টাইল মেডিসিন খেতে হবে। এই লাইফস্টাইল মেডিসিন হচ্ছে দিনে দুবেলা মেডিটেশন।

আপনি যত নিয়মিত মেডিটেশন করবেন তত আপনি থাকবেন প্রশান্ত-প্রফুল্ল, রাগ স্ট্রেস দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতামুক্ত। রক্তচাপ থাকবে নিয়ন্ত্রণে। আর এর নেট রেজাল্ট হিসেবে আপনার হৃদযন্ত্র থাকবে সুস্থ।

আরো পড়ুন :-