মেডিটেশন : হৃদরোগ প্রতিরোধে

published : ২৫ আগস্ট ২০১৫

ডা. ডেভিড ওরমে জনসনের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার হার ৮৭.৩% কম। আসলে সবচেয়ে বড় বড় যে ঝুঁকিগুলোর কারণে হৃদরোগ হয়, যেমন, কোলেস্টেরল বেশি হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, মোটা হয়ে যাওয়া এবং স্ট্রেস–এই বিষয়গুলো, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করে তাদের হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক কমে যায়।

  • কোলেস্টেরল

  • হাই ব্লাড প্রেশার

  • ডায়াবেটিস

  • ধূমপান

  • স্থূলতা

  • স্ট্রেস

কোলেস্টেরল

কোলেস্টেরল হার্ট এটাকের প্রাথমিক কারণ। মেডিটেশন অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে। ১৯৭৯ সালে দুজন গবেষক এম জে কুপার এবং এম এম আইজেন ২৩ জন উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর মধ্যে ১২ জনকে মেডিটেশন করান। ১১ মাস পর দেখা যায় যে, মেডিটেশনকারী গ্রুপের কোলেস্টেরল ২৫৫ থেকে ২২৫-এ নেমে এসেছে। আমেরিকায় ২২০ মাত্রাকে স্বাভাবিক গড় মাত্রা ধরা হয়।

মেডিকেল কলেজ অব জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট ডা. বার্নেস ১১১ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এক গবেষণা চালান। এদের মধ্যে ৫৭ জনকে মেডিটেশন করানো হয়, বাকিদের শুধু স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্যাদি শেখানো হয়।

অাট মাস পর দেখা যায়, ১ম গ্রুপের সদস্যদের রক্তবাহী নালীর সংকোচন-সম্প্রসারণ ক্ষমতা বেড়েছে ২১%, যা হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ, এনডোথিলিয়াম নামের রক্তনালীর আবরণের এই অসুবিধা থেকেই অল্পবয়সে একজন মানুষের শরীরে শুরু হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, ২য় গ্রুপের এ ক্ষমতা কমেছে ৪%। বয়স বাড়লে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ১ম গ্রুপের ক্ষেত্রে কমেছে। ডা. বার্নেস বলেন, লিপিড কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে যে ফল আগে পাওয়া যেত তা-ই পাওয়া যাচ্ছে মেডিটেশনে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে এ রিপোর্টটি পেশ করা হয়।

হাই ব্লাড প্রেশার

এখন থেকে ৩ দশক আগেই হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ড. হার্বার্ট বেনসনের গবেষণায় দেখা যায় যে, মেডিটেশনের ফলে রক্তচাপ কমে। তারপর থেকে এ যাবৎকালে শত শত গবেষণায় এ বিষয়টিই বার বার উঠে এসেছে যে, মেডিটেশন রক্তচাপ কমায়।

১৯৯৪ সালে লিন্ডেন এবং চেম্বার্স পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টলিক প্রেশার কমানোর ক্ষেত্রে মেডিটেশন রাসায়নিক ওষুধের মতোই কাজ করে। ১৯৯৭ সালের আরেক গবেষণায় ড. শাপিরো দেখান, ছয় সপ্তাহ ধরে শিথিলায়ন এবং দৃষ্টিভঙ্গি বদলের অনুশীলন করেছেন যে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা তাদের ওষুধ লেগেছে অন্যদের চেয়ে কম। শুধু মেডিটেশন চর্চা করে অধিকাংশ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগী অনায়াসেই নিজের প্রেশার সংকটসীমার নিচে অর্থাৎ ১৩০/৯০-এ নামিয়ে আনতে পারেন এবং এতে তার স্ট্রোক করার সম্ভাবনা বহুগুণ হ্রাস পায়।

২০০৪ সালে আমেরিকার জার্নাল অব হাইপারটেনশন-এ ১৫৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর তিন মাস ধরে চালানো গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, প্রেশার কমাবার জন্যে যারা খাবার বা ব্যায়ামনির্ভর চর্চা করেছে এবং যারা কিছুই করে নি—এই দুই গ্রুপের তুলনায় যারা মেডিটেশন করেছে তাদের সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টলিক দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জন্যে প্রকাশিত উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসার গাইডলাইনে যৌথভাবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন জীবনধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও প্রাণায়াম চর্চার কথা বলেছে।

ডায়াবেটিস

গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত মেডিটেশন অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ২০০৮ সালে থাইল্যান্ডের বিজ্ঞানী চাইওপানোন্ট ৫০ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর গবেষণা করেন। সকালে নাশতার পর এই রোগীদেরকে তিনি মেডিটেশন করান। দেখা গেল, মেডিটেশন এবং পরিমিত জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক আছে।

আরেক গবেষণায় রোজেনউইক ও তার সহকর্মীরা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে HbA1c (গাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লাবিন)-এর মাত্রা পর্যবেক্ষণ করেন। HbA1c হলো একধরনের গ্লুকোজ জাতীয় হিমোগ্লোবিন যা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে দেখা যায়। তারা দেখেন, মেডিটেশন রক্তে এই HbA1c—এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। সেইসাথে রক্তচাপকেও স্বাভাবিক রাখে। এমনকি এই গবেষণাও প্রমাণ করে, মেডিটেশন হতাশা, দুশ্চিন্তা ও নানারকম মানসিক অস্থিরতা কমায়। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ার এগুলোও উল্লেখযোগ্য কারণ।

ধূমপান

২০০৭ ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের স্কুল অব মেডিসিন এন্ড পাবলিক হেলথের গবেষক ডেভিস ও তার সহযোগীরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেন ১৮ জন ধূমপায়ীর ওপর, যারা প্রায় ২৭ বছর ধরে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ২০টা করে সিগারেট খেতেন। মেডিটেশন শেখার সময়ই তারা ধূমপান ছেড়ে দেন। ছয় সপ্তাহ পরে তাদের দেহের কিছু পরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, তাদের মধ্যে ১০ জন সত্যি সত্যিই স্থায়ীভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন।

স্থূলতা

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেডিটেশন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে সহায়তা করে। ইন্ডিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব হেলথ, রিলিজিয়ন এন্ড স্পিরিচুয়ালিটি-র ডিরেক্টর জেন ক্রিসলার ১৮ জন স্থূলকায়া মহিলার ওপর এক গবেষণা চালান। দেখা গেল মেডিটেশন করার পর তাদের ওজন বৃদ্ধির হার কমেছে। আগে যেখানে সপ্তাহে ছিল চার তা এখন মাত্র দেড়।

গবেষক সিং এবং তার সহকর্মীরা এক গবেষণায় দেখতে পান যে, প্রেডার-উইলি সিনড্রোমে আক্রান্ত অল্পবয়স্করা যদি নিয়মিত মেডিটেশন, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করে, তবে তারা ওজন কমাতে সফল হয়। প্রেডার-উইলি সিনড্রোম হলো অতিভোজনের কারণে ওজন বাড়ার এক ধরনের বংশগত রোগ। এই রোগে আক্রান্তরা অনেক খাওয়া-দাওয়ার পরও সবসময় ক্ষুধাবোধে ভুগতে থাকে। ফলে ছোটবেলা থেকেই মোটা হতে হতে এক সময়ে চলে যায় আয়ত্তের বাইরে এবং আক্রান্ত হয় নানা জটিলতায়।

স্ট্রেস

স্ট্রেস শুধু আমাদের মানসিক প্রশান্তিই নষ্ট করে না; বরং এটি দেহে সৃষ্টি করে নানারকম রোগ। ফলে কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার কারণে গুণতে হয় কোটি কোটি টাকার লোকসান। হার্ভার্ডের ফিজিওলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেই আবিষ্কার করেন যে, আমরা যখন স্ট্রেসড হই তখন আমাদের রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, মাংসপেশির চাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়।

হার্ভার্ডেরই আরেক গবেষক ডা. হার্বার্ট বেনসন ১৯৬৭ সালে দেখান যে, মেডিটেশন আমাদের শরীরে স্ট্রেসের ঠিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটায় অর্থাৎ রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন, মাংসপেশির চাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে স্বাভাবিক রাখে। তার লেখা 'দ্যা রিলাক্সেশন রেসপন্স' বইয়ে তিনি বলেছেন, স্ট্রেসের কারণে আমাদের দেহে যে '‌ফাইট অর ফ্লাইট'' রেসপন্স সৃষ্টি হয়, সেটিকে প্রশমিত করে মেডিটেশন মন ও দেহকে অধিকতর শান্ত ও সুখী অবস্থায় নিয়ে আসে। বইটি ছিল সর্বাধিক বিক্রিত।

অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেডিটেশন আমাদের দেহে স্ট্রেসের জন্যে দায়ী হরমোন কর্টিসলের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। ক্রনিক স্ট্রেস আমাদের শরীরে 'অক্সিডেটিভ স্ট্রেস' বাড়িয়ে দিয়ে বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে এবং ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাজমা, সোরিয়াসিসের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন 'অক্সিডেটিভ স্ট্রেস' হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৬ ও ২০০৮ সালে গবেষক ড্যান উইজক ও তার সহকর্মীরা ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর এক অভিনব পদ্ধতি 'আলট্রা উইক ফোটন ইমিশন মেসারমেন্ট' প্রয়োগ করে তাদের দেহকোষে বিক্রিয়াশীল অক্সিজেন পরিমাপ করেন এবং দেখতে পান যে, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের দেহে এই ফোটন রেডিয়েশন এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের মাত্রা অনেক কম।