published : ১১ জুন ২০১৬
প্রত্যন্ত ইকুয়েডরে অস্বাভাবিক ক্ষুদ্রাকৃতির কিছু মানুষের সন্ধান পাবার পর দীর্ঘজীবনের রহস্য নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীদের সামনে বেশকিছু জটিল প্রশ্নের সমাধান খুলে গেল। বিরল লারসেন সিনড্রোমে আক্রান্ত এই মানুষগুলো পূর্ণবয়স্ক হবার পরও বামনাকৃতির থেকে যায়। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিনশর মতো এরকম মানুষ আছে।
গবেষকরা দেখলেন, এদের দেহে আইজিএফ-১ নামে গ্রোথ হরমোনটির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কম। কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে তারা দেখলেন যে, এই মানুষগুলোর একজনেরও ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা ক্যান্সার হবার কোনো ইতিহাস নেই।
আর এদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা বুঝলেন যে, দীর্ঘজীবনের সাথে আইজিএফ-১ হরমোনের একটা সম্পর্ক আছে। গ্রোথ এ হরমোনটির উপস্থিতির কারণে দেহের ভেতর সবসময় একটা সক্রিয় অবস্থা বিরাজ করে। একটা বাড়ন্ত, নির্মাণাধীন অবস্থা! কিন্তু আইজিএফ-১ যখন কমে যায়, তখন দেহে সৃষ্টি হয় সম্পূর্ণ এক ভিন্ন অবস্থা। নতুন কোষের উৎপাদন থেমে গিয়ে দেহ তখন নিয়োজিত হয় পুরনো কোষ মেরামতে, ডিএনএ-র ক্ষয়পূরণে। আর ক্ষয়পূরণ মানেই হলো বয়সঘটিত অসুখ বিসুখগুলো না হওয়া। ইকুয়েডরের বামন মানুষদের সুস্থতার রহস্য এখানেই, তাদের দেহে আইজিএফ-১ কম থাকা ।
শুধু তাই না, পরীক্ষাটাকে বিজ্ঞানীরা ল্যাবেরেটরিতেও নিয়ে গেছেন। একই বয়স, প্রজাতি এবং লিঙ্গের দুটি ইঁদুরের একটির দেহের আইজিএফ-১ এর মাত্রাকে অস্বাভাবিক কমিয়ে দেখা গেল সমগোত্রীয় ইঁদুরটির তুলনায় তার বেঁচে থাকার সময় বেড়ে গেছে ৪০%, মানুষের আয়ুষ্কালের মাপকাঠিতে যা ৩০/৪০ বছর।
এখন প্রশ্ন হলো, বেশি খাওয়া বা কম খাওয়ার সাথে গ্রোথ হরমোন আইজিএফ-১ এর সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা আসলে খুব সহজ। আপনি যত বেশি খাবেন, বিশেষত যত বেশি প্রোটিন খাবেন, আপনার দেহ তত বেশি আইজিএফ-১ হরমোন তৈরি করবে, আর তার প্রভাবে দেহ তত বেশি সক্রিয় অবস্থায় থাকবে। ফলে কোষের ক্ষয়পূরণ বা মেরামতে মনোযোগ দেয়ার চেয়ে নতুন কোষ তৈরিতেই দেহ বেশি ব্যস্ত হবে। আর ডায়াবেটিস বা ক্যান্সারের মতো রোগগুলো তখনই হয়, যখন কোষের ক্ষয়পূরণের চেয়ে বৃদ্ধির হার বেশি হয়। বিশেষত, ক্যান্সারের একটা বড় কারণ শরীরে আইজিএফ-১ এর উচ্চমাত্রা। স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
অন্যদিকে আপনি যখন কম খান, আপনার দেহে তখন আইজিএফ-১ এর পরিমাণ কমে যায়, দেহ তখন এক ধরনের বিশ্রাম বা বিরতি পায়, মনোযোগ দিতে পারে কোষের মেরামতে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাওয়া কমাবার চেয়েও এ প্রক্রিয়ায় অনেক দ্রুত এবং কার্যকরী ফল আসতে পারে যদি কেউ পুরোপুরি খাওয়া থেকে বিরত থাকে অর্থাৎ উপবাস বা রোজা করে ।
খ্যাতনামা টিভি জার্নালিস্ট মাইকেল মজলি । স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক ডকুমেন্টারির একজন জনপ্রিয় উপস্থাপক। উপবাসের চমকপ্রদ ফলের কথা শুনে তিনি নিজের ওপরেই এর প্রভাব দেখার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু করেন উপবাস- চার রাত তিন দিন একটানা। এসময়ে তার খাবার বলতে ছিল প্রতিদিন এক কাপ ব্ল্যাক টি, ৫০ ক্যালোরি মানের স্যুপ আর পানি!
শুরুর আগে একবার নিজের আইজিএফ-১ মেপে নিয়েছিলেন। উপবাস শেষে যখন আবার মাপলেন, মাইকেল মজলি বিস্মিত। মাত্র তিনদিনের উপবাসে তার আইজিএফ-১ নেমে এসেছে অর্ধেকে! যার মানে প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার যে ঝুঁকি তার ছিল (মজলির বাবাও প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন) তা নেমে গেছে অর্ধেকে! কমে গেছে ব্লাড সুগারও।
এ ফলাফল তাকে এত উৎসাহিত করল যে, পরবর্তী ৫ সপ্তাহেও তিনি এ উপবাস অব্যহত রাখলেন। এসময় সপ্তাহে ২ দিন (উপবাসের দিন) তিনি মাত্র ৬০০ ক্যালরি গ্রহণ করতেন। বাকি দিনগুলোর তুলনায় যা ছিল চারভাগের একভাগ।
ফলাফল আরো চমকপ্রদ। ৫ সপ্তাহে তার ওজন কমে গেল প্রায় ৮ কেজি, বডিফ্যাট কমে গেল ২৭ থেকে ২০-এ এবং আইজিএফ-১ হরমোন নেমে এল অর্ধেকে। মাইকেল মজলি এখন 5:2 Fast Diet নামে এক স্বাস্থ্যাভ্যাস আন্দোলনের প্রবক্তা যার মাধ্যমে তিনি উপবাসের শারীরিক উপকার নিয়ে কাউন্সেলিং করে থাকেন।