published : ১০ অক্টোবর ২০২৫
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা একটি বড় স্থান দখল করে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ৪ শতাংশ তথা ৩৩ কোটিরও বেশি মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে। বাংলাদেশেও এই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। বিশেষত তরুণ ও কর্মজীবী মানুষদের মধ্যে এর প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
ডিপ্রেশন বলতে অনেকে মন খারাপকে বুঝে থাকেন। তবে সাধারণ মন খারাপ নিজে থেকে চলে গেলেও ডিপ্রেশন সাধারণত নিজে থেকে যায় না। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মন খারাপ ছাড়াও খিটখিটেভাব, দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সবকিছুর ব্যাপারে নিরানন্দ বা অনাগ্রহ, শূন্যতাবোধ ইত্যাদিতে ভোগেন, এবং তা অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে, প্রায় প্রতিদিন, দিনের প্রায় পুরোটা জুড়ে।
এছাড়াও, মনোযোগে ঘাটতি, অতিরিক্ত অপরাধবোধ, হীনম্মন্যতা, ভবিষ্যত নিয়ে নিরাশা, খাবারে অনাগ্রহ, অনিদ্রা, আত্মহত্যাচিন্তা ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেয়া যায় বিষণ্ণতায় আক্রান্তদের মধ্যে।
ডিপ্রেশন সৃষ্টি হতে পারে পরিবেশগত, মানসিক, জিনগত, জৈব-রাসায়নিক ইত্যাদি নানা কারণেই। যার মধ্যে আছে ক্রনিক স্ট্রেস তথা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ, দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন বা সহিংসতার শিকার হওয়া, গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি, সুযোগ নষ্ট, প্রিয়জনের মৃত্যু বা তার সাথে বিচ্ছেদ, ক্রনিক অসুস্থতা ইত্যাদি।
বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লিজের গবেষক দলের প্রধান ডা. স্টিভেন লরিস। নিউরোসায়েন্সের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক। পেশাজীবনে সফল এবং ব্যক্তিজীবনে সুখী এই মানুষটিই আক্রান্ত হন বিষণ্ণতায়! কারণ ছিল দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন আর শিশু-কিশোর ৩ সন্তানকে রেখে স্ত্রীর ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়া। তার ভাষায়-
“It was a real shock! একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে যত জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম, তার কিছুই আমার কোনো কাজে লাগল না।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো থেরাপি, কোনো পিল, অয়েন্টমেন্ট, অপারেশন আমার কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দিতে পারল না। আমি সুস্থ জীবন থেকে বিচ্যুত হলাম। সিগারেট এবং অ্যালকোহল ধরলাম স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। কিন্তু এন্টিডিপ্রেসেন্ট পিল, স্লিপিং পিল কোনোটাই কাজে আসল না। আমি মানসিকভাবে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। জীবন একেবারে এলোমেলো হয়ে গেল।”
তার মানে এত সফল একজন ডাক্তার, এত খ্যাতি, এত প্রতিপত্তি- কিন্তু বিষণ্ণতা থেকে তিনিও কিন্তু ইমিউন না! তাহলেই বুঝুন একজন সাধারণ মানুষ, মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে যার সেভাবে জ্ঞানই নেই, বিষণ্ণতা থেকে তিনি কতটা অরক্ষিত।
জীবনের এই ক্রান্তিকালে একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে তিনি মেডিটেশন চর্চা শুরু করেন। কিছুদিন চর্চায় তার ডিপ্রেশন কেটে যায়। তিনি আগের মতো প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত তার the no-nonsense meditation book : A scientist's guide to the power of meditation বইয়ে তিনি তার এই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। যেখানে তিনি বলেন,
“(মেডিটেশন করে) আমি উপব্ধি করলাম যে, আসলে অতীত নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমি বর্তমান মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে শিখলাম।
মেডিটেশন হয়তো আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোকে বদলে ফেলতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত প্রতিটি ঘটনায় আমার দেহ-মন কীভাবে প্রভাবিত হবে—সেই বিষয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে মেডিটেশন।
মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম। যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায়, তার পায়ের পেশি মজবুত হয়; আবার কেউ যখন সাঁতার কাটে, তার হাতের পেশির শক্তি বাড়ে। তেমনি আমরা যখন মেডিটেশন করি, মস্তিষ্কের ভেতরেও আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন।”
১. হরমোন নিঃসরণ স্বাভাবিক করে
সেরোটনিন, ডোপামিন, এন্ডোর্ফিন— আমাদের মন ভালো আর মুড চাঙা রাখা এই হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর নিঃসরণ কমে যায় যখন কেউ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন। অন্যদিকে, বেড়ে যায় স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের নিঃসরণ। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন মুড স্ট্যাবিলাইজার ও এন্ট্রি-ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ দিয়ে আসলে এই হরমোনগুলোর নিঃসরণকেই স্বাভাবিক করা হয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, মেডিটেশনে বাড়ে ডোপামিন, সেরোটনিন, এন্ডোর্ফিনের নিঃসরণ এবং কমে কর্টিসলের নিঃসরণ। মেডিটেশনের পর যে সুখ সুখ অনুভূতি আপনি পান তা এ-কারণেই।
২. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে
নিয়মিত মেডিটেশনে মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (যে অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে) সক্রিয় হয়। এটি অ্যামিগডালার (ভয় ও উদ্বেগের কেন্দ্র) কার্যকলাপ কমিয়ে দেয়। ফলে মনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসে।
৩. মাইন্ডফুলনেস বৃদ্ধি
ডিপ্রেশনে ভোগা ব্যক্তিরা প্রায়শই অতীত নিয়ে অনুশোচনা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। মেডিটেশন আমাদের মাইন্ডফুল, অর্থাৎ বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দিতে শেখায়। এতে অস্থির মন হয় শান্ত, কমে মানসিক চাপ, বাড়ে জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি।
৪. ঘুমের মান উন্নত করে
পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ডিপ্রেশন ছোবল মারে এই ঘুমের ওপর। ডিপ্রেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো অনিদ্রা। মেডিটেশন মনকে শান্ত করে। যার ফলে ঘুমের মান হয় উন্নত।
৫. নিজের প্রতি সহানুভূতি তৈরি
মেডিটেশন অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলো সম্পর্কে আরও সচেতন হয়। তখন তারা নিজেদের বিচার না করে সহানুভূতি নিয়ে দেখতে শেখে। যা অহেতুক অনুশোচনা ও অপরাধবোধ কমিয়ে ডিপ্রেশনের চক্র ভাঙতে সাহায্য করে।
মাইন্ডফুলনেস-বেসড স্ট্রেস রিডাকশন (MBSR) প্রোগ্রামের প্রবক্তা মনোবিজ্ঞানী ড. জন কাবাত-জিন বলেন, "আপনি ঢেউ আটকাতে পারবেন না, কিন্তু আপনি সার্ফিং করা শিখতে পারেন।"
ডিপ্রেশনের ঢেউ এলেও মেডিটেশন আমাদের সেই ঢেউগুলোর উপর ভেসে থাকার শক্তি যোগায়। ডিপ্রেশনের রোগীরা আশার আলো দেখতে পান না। তাদের জীবনে অন্ধকার টানেলের শেষে এক চিলতে আলোর রেখা দেখাতে পারে মেডিটেশন।
প্রতিদিন মাত্র ১০-১৫ মিনিটের নীরবতা, স্থিরতা, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসে মনোযোগ— এগুলোই আপনার মনকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। একটি নীরব স্থান, আরামদায়ক স্বাভাবিক পোশাক আর কিছুটা সময়ই যথেষ্ট। প্রথম প্রথম কঠিন লাগতে পারে, মন এখানে-সেখানে ছুটতে পারে; কিন্তু লেগে থাকলে আপনি ঠিকই এর সুফল দেখতে পাবেন।
চর্চা নিজে নিজেই করতে পারেন। তবে শুরুতে যদি মেডিটেশন অডিও গাইড ব্যবহার করেন তাহলে সহজ হবে অনুশীলন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মেডিটেশন সাইট থেকে ফ্রি মেডিটেশন ডাউনলোড বা সরাসরি প্লে করে চর্চা করতে পারেন। প্রথম ৪০ দিন দুবেলা শিথিলায়ন; এরপর থেকে একবেলা শিথিলায়ন এবং অন্যবেলা আপনার প্রয়োজনমত অন্য একটি মেডিটেশন- এভাবে করাটাই উত্তম।
আর যদি চান কোয়ান্টাম মেথডের উদ্ভাবক ও প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে মেডিটেশন শিখবেন, তাহলে সে উপায়ও আছে! প্রায় প্রতি মাসেই অনুষ্ঠিত হয় ৪ দিনের কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন কোর্স। শুধু মেডিটেশন শেখাই নয়, এই কোর্সে অংশ নিয়ে ডিপ্রেশন থেকে নিরাময়ও লাভ করেছেন অনেকে।
কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করে তারা পেরেছেন আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করতে!
কোয়ান্টাম মেথড কোর্স ফি : বেশি, না কম?
Major Depressive Disorder or Clinical Depression নিরাময়ে মেডিটেশন ঔষধ বা থেরাপির বিকল্প নয়, বরং সহায়ক শক্তি। গুরুতর ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। মেডিটেশন এক্ষেত্রে নিরাময়কে ত্বরান্বিত করে। তবে দৃশ্যমান ফলাফল পেতে ধৈর্যের সাথে নিয়মিত মেডিটেশন চালিয়ে যেতে হবে। আর সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শে ওষুধ সেবন শুরু করে থাকলে তার সাথে কনসাল্ট না করে কোনোক্রমেই ওষুধ বাদ দেবেন না।