দীর্ঘজীবনের রহস্য জানুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন

মানুষের গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল প্রায় ৭৩ বছর। তবে কেউ কেউ এর চেয়েও বেশি সময় যেমন বাঁচে, তেমনি এর কম বয়সেও মারা যান অনেকে। অল্প বয়সে মৃত্যুর বড় কারণ দুর্ঘটনা ও দুরারোগ্য ব্যধি।

স্বাভাবিক মৃত্যু কখন ঘটে?

কোটি টাকার প্রশ্ন! উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের ডিএনএ-তে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, আমরা কতদিন বাঁচব তা লেখা আছে আমাদের প্রত্যেকের ডিএনএ-তে। আমাদের দেহকোষের ক্রোমোজমের দুই মাথায় টুপির মতো চারটি অংশ আছে। এর নাম টেলোমিয়ার। একজন মানুষ যেদিন ভূমিষ্ট হয় সেদিন থেকে থেকে শুরু হয় টেলোমিয়ারের ক্ষয়।

জন্মের পর প্রতিনিয়ত কোষ বিভাজন হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন দেহকোষ। ফলশ্রুতিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে টেলোমিয়ার। যেদিন টেলোমিয়ার পুরোপুরি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে সেদিন ঘটবে মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু এটাই।

আয়ু বাড়ানো যায়!

বিজ্ঞানীরা বলছেন ভুল লাইফস্টাইলের কারণে টেলোমিয়ার দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। এটি নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পান ড. এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন এবং ড. ডীন অর্নিশ। তাদের যৌথ গবেষণা বলে যে, একজন মানুষ যদি ভুল লাইফস্টাইল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে তার টেলোমিয়ারে লেখা ১২০ ১৩০ ১৪০ বছর- এটা পূর্ণ করেই তিনি পৃথিবী থেকে যাবেন।

বলবেন ভুল লাইফস্টাইলের কারণে ইতিমধ্যেই তো টেলিমিয়ার ক্ষয়ে গেছে! এক্ষেত্রে প্রয়োজন রিভার্সাল। মানে টেলোমিয়ারের যতটা অতিরিক্ত ক্ষয় হয়ে গেছে সেটা পূরণ করে আবার আগের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এজন্যে প্রয়োজন খাবার নিয়ন্ত্রণ, যথাযথ খাবার গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা, মেডিটেশন এবং বিজ্ঞানসম্মত লাইফস্টাইল অনুসরণ।

'যথাযথ খাবার' বলতে আসলেই কি কিছু আছে?

উত্তর- আছে! পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীরই খাবারের নির্ধারিত প্রকৃতি আছে, এবং তারা সেই খাবারই খায়। বাঘ সিংহ ভালুক ইত্যাদি মাংসাশী প্রাণী শাকসবজি লতাপাতা যেমন খাবে না, গরু ছাগল হরিণ কখনো খাবে না মাংস। কিন্তু প্রাণীকূলে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হলো মানুষ! নৃতাত্ত্বিক ও শারীরবৃত্তীয়ভাবে মূলত তৃণভোজী হওয়া সত্ত্বেও এখন আমরা বেশি খাই মাছ মাংস। ফলাফল- অসংক্রামক রোগ!

হৃদরোগ স্ট্রোক ডায়াবেটিস মেদস্থূলতা উচ্চ রক্তচাপ ক্যান্সার- এই রোগগুলোকে একত্রে বলা হয় অসংক্রামক রোগ। তিন যুগ আগেও এই রোগগুলোতে মৃত্যু ছিল মোট মৃত্যুর মাত্র ৮ শতাংশ। অথচ এখন এই হার ৭৭ শতাংশ! মূল কারণ প্রাণীজ আমিষ।

হরিণ হার্ট এটাক করেছে, কিংবা বাঘ স্ট্রোক করে পা বাঁকিয়ে ফেলেছে বলে কখনো শুনেছেন? শোনেন নি! কারণ এই প্রাণীগুলো কখনো তাদের প্রকৃতি-বিরুদ্ধ খাবার খায় না। মানুষ খায়; পরিণতিও তাই মেলে হাতেনাতে।

প্রকৃতিসিদ্ধ খাবারে মেলে দীর্ঘজীবন

পৃথিবীতে এমন পাঁচটি জনপদ আছে যেখানে মানুষ বাঁচে শত বছর। এগুলো হচ্ছে জাপানের ওগিনেওয়া দ্বীপ, গ্রিসের ইকারিয়া দ্বীপ, ইটালির সার্ডেনিয়া দ্বীপ, কোস্টারিকার নিকোয়া প্যানেনসুলা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লোমালিন্ডা। অঞ্চলগুলোকে একসাথে অভিহিত করা হয় ব্লু জোনস নামে।

এরকম আরেকটি জনপদ হচ্ছে হুঞ্জা ভ্যালী। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে পাকিস্তানের উত্তরে অবস্থিত চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দোর্য্যমণ্ডিত এই এলাকায় মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছর। যেখানে পাকিস্তানীদের গড় আয়ু এর অনেক কম- ৬৭ বছর।

ব্লু জোনস এবং হুঞ্জা ভ্যালির অধিবাসীরা ফাস্টফুড প্রসেসড ফুড খায় না; তারা অভ্যস্ত সবজি ফলমূল বাদাম ইত্যাদি প্রাকৃতিক খাবারে। এই খেয়েই তারা পেয়েছে শতবর্ষী সুস্থজীবন।

মেক্সিকোর তারাহুমারা উপজাতির ঘটনা

মেক্সিকোর উত্তর সনোরায় তাদের বাস। সমুদ্র থেকে উঁচু পার্বত্য এলাকাটির অনুর্বর জমিতে জন্মায় কেবল ভুট্টা। এক বছরে তাদের খাবারের পরিমাণ ১০০ কিলোগ্রাম কর্ন। মাংস খেতে পায় বছরে ২/১ দিন ‘শিন্নির’ মতো। তাদের মন-দেহ প্রক্রিয়া চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল এই তথাকথিত ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড ডায়েটে’র সাথে। অসুখ-বিসুখবিহীন ঈর্ষণীয় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তারা। দৌড়াতে পারে ২৫ থেকে ৫০ মাইল।

পরিস্থিতি পুরো বদলে গেল যখন তারা পাশ্চাত্যের সভ্য মানুষদের পাল্লায় পরল। তাদেরকে দেয়া হলো ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন সমৃদ্ধ স্ট্যান্ডার্ড খাবার। এক বছরের মধ্যেই তাদের মধ্যে মহামারি আকারে দেখা দিল হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, চর্মরোগ, দন্তরোগ, এলার্জি ইত্যাদি যার কোনোটিরই অস্তিত্ব তাদের মধ্যে ছিল না।

তাই খান 'মানুষ-উপযোগী' খাবার!

উপর্যুক্ত কারণে বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন খাদ্য হতে হবে 'মানুষ-উপযোগী', বাঘ বা গরুর উপযোগী নয়। যথাসম্ভব কমাতে হবে প্রাণীজ আমিষ গ্রহণ, বাড়াতে হবে উদ্ভিজ্জ খাবার। প্যাকেটজাত প্রক্রিয়াজাত গুরুপাক ভাজাপোড়া খাবার গ্রহণ নামিয়ে আনুন শূন্যের কোঠায়।

স্ন্যাকস খাওয়া বন্ধ করুন; তাহলে ইনসুলিন হরমোন অতিরিক্ত নিঃসরণ কম হবে, কমে যাবে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা।

খাবার গ্রহণ করুন দিনে তিন বার। মাঝের সময়টায় ঘন ঘন এটাসেটা খাওয়ার অভ্যাস ছাড়ুন।

লাইফস্টাইল মেডিসিন : দিনে দুবেলা মেডিটেশন!

রিডার্স ডাইজেস্ট ২০১০ সালে একটি নিবন্ধ করে 'রিলাক্সেশন চেঞ্জেস জিনস' নামে। এতে বলা হয়-

‘Study shows meditation turns off stress related genes, deep relaxation from meditation & yoga known as the relaxation response can change our bodies’.

অর্থাৎ মেডিটেশন এটি শুধু চোখ বন্ধ করে ঝিমানোর বিষয় নয়। আপনি যদি নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাহলে ভুল খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচার ও স্ট্রেসের দরুন জিনে সৃষ্ট অস্বাভাবিকতা দূর ও টেলিমিয়ারের ক্ষয় পুনর্গঠন হবে।

সেই সাথে যদি সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধঘন্টা করে যোগব্যায়াম যদি করেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা! স্বাস্থ্যকর খাবার, সুস্থ জীবনাচার, মেডিটেশন আর যোগব্যায়াম- সব মিলিয়ে আপনি পাবেন সুস্থ কর্মময় দীর্ঘজীবন।