তৃণভোজী, মাংসাশী এবং সর্বভূক- খাবারের প্রকৃতিভেদে প্রাণীকূলের সকল জীবকে মোটাদাগে এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। কোন প্রাণী কী খেয়ে বাঁচবে এবং খাবার তার শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডে কী প্রভাব ফেলবে তাও এক প্রকার সুনির্দিষ্ট।
বাঘ-সিংহ সারাবছর মাংসই খায়; গরু-ছাগল বা হরিণের অরুচি নেই প্রতিদিন ঘাসপাতা খাওয়ায়। কারণ এগুলোই এদের প্রকৃতি-নির্ধারিত খাবার।
বছরের বারো মাস ঘাসপাতা খাওয়ায় অরুচি নেই হরিণের (ছবিসূত্র-flickr.com)
মানুষেরও কি খাবারের কোনো প্রকৃতি-নির্ধারিত ধরণ আছে?
উত্তর খুঁজতে দ্বারস্থ হতে হবে নৃবিজ্ঞানীদের। তাদের মতে আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মূলত ভেজিটারিয়ান বা নিরামিষাশী। এর সপক্ষে তারা দুটো প্রমাণ উপস্থাপন করছেন- এক) পরিপাকতন্ত্রের গঠন, দুই) দাঁতের গঠন।
হরিণের কথাই ধরা যাক। হরিণ তৃণভোজী; এর মুখ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য গড়ে ২৮ ফুট। অন্যদিকে, মাংসাশী প্রাণী বাঘের পরিপাকতন্ত্রের গড় দৈর্ঘ্য ৩ থেকে ৭ ফুট।
তৃণভোজী হয়েও হরিণের পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ার কারণ সবজি পাতা তৃণলতায় প্রচুর আঁশ বা ফাইবার থাকে, যা হজম করার জন্যে প্রয়োজন দীর্ঘ পরিপাকতন্ত্র। বিপরীতে, মাংসে যেহেতু ফাইবার থাকে না তাই বাঘের পরিপাকতন্ত্র এত লম্বা হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য কত জানেন? গড়ে ৩০ ফুট! অর্থাৎ, হরিণের চেয়েও বেশি। কাজেই মাংসাশী বাঘ-সিংহ নয়, মানুষের খাবার হওয়া উচিৎ তৃণভোজী গরু-ছাগল-হরিণের মতো।
শুধু পরিপাকতন্ত্রই না, দাঁতের গঠনেও মানুষের সাথে মিল রয়েছে তৃণভোজী প্রাণীদের
মাংসাশী প্রাণীর সাথে মানুষের মাত্র ৪টি দাঁতের মিল আছে। এগুলোকে বলা হয় ক্যানাইন টুথ। কারণ আমাদের মুখের দু’পাশে উপর-নিচ এই দাঁতগুলো মাংসাশী প্রাণী কুকুরের দাঁতের মতোই চোখা। বাকি ২৮টি দাঁত তৃণভোজী প্রাণী গরু-ছাগলের মতো।
মুখের দুপাশে উপর ও নিচে ৪টি দাঁতকে বলা হয় ক্যানাইন টুথ (ছবিসূত্র- বিজনেস ইনসাইডার)
অনুপাত দাঁড়ায় ২৮:৪ বা ৭:১!
অর্থাৎ, প্রকৃতিগতভাবেই আমরা মূলত তৃণভোজী। প্রকৃতি বলছে সাতদিন শাক-সবজি তরি-তরকারি আর একদিন মাছ-মাংস হওয়া উচিৎ আমাদের খাদ্যাভ্যাস।
কিন্তু আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাস ঠিক এর উল্টো!
বেশিরভাগ মানুষ সাতদিন খায় মাছ মাংস, নামকাওয়াস্তে একদিন হয়ত সবজি। যেদিনও বা আমরা শখের ‘ভেজিটারিয়ান’ হই সেদিনও পাতে থাকে নিদেনপক্ষে ডিম ভাজা! প্রকৃতিবিরুদ্ধ এই খাদ্যাচারের ফলাফল- বিশ্বজুড়ে উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ ডায়াবেটিস স্ট্রোক স্থূলতা ফ্যাটি লিভার ডিজিজ ক্যান্সার এখন ঘরে ঘরে।
এই রোগগুলোকে একত্রে বলা হয় অসংক্রামক রোগ।
দেশে এখন ৭৩ ভাগ মৃত্যুর কারণ এই ‘অসংক্রামক রোগ’
অর্থাৎ, প্রত্যেক বছর বাংলাদেশে প্রতি ১০০ মৃত্যুর ৭৩-ই হৃদরোগ ডায়াবেটিস স্ট্রোক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ ক্যান্সারে। ৩৬ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। ১৯৮৬ সালে, অর্থাৎ মাত্র তিন যুগ আগেও বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মারা যেত মাত্র ৮% মানুষ।
কিন্তু এখন কেন এত? কারণ খাদ্যাভ্যাসে বদল।
গত কয়েক দশকে আমরা অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছি প্রাণিজ আমিষের দিকে (ছবিসূত্র-newfoodmagazine.com)
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে আমাদের খাদ্যাভ্যাসও আমূল বদলে গেছে; মাছ-মাংস হয়ে গেছে অনেক সহজলভ্য; আমরা শাকসবজি ছেড়ে ঝুঁকে পড়েছি প্রাণিজ আমিষে। ফলাফল- অসংক্রামক রোগ আর তাতে ক্রমবর্ধমান মৃত্যহার!
প্রাণিজ আমিষ- সর্বনাশের ‘নাটের গুরু’!
চীনের কয়েকটি এলাকায় কিছু দীর্ঘজীবী মানুষ আছে যাদের হৃদরোগ উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস নেই। অন্যদিকে, আমেরিকার কিছু অঞ্চল আছে যেখানে এসব রোগ ঘরে ঘরে। এই দুই অঞ্চলের মানুষের ওপর গবেষণা চালান কর্নেল ইউনিভার্সিটি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং চায়নিজ একাডেমি অব প্রিভেনটিভ মেডিসিনের এক দল গবেষক।
দীর্ঘ তিন দশক গবেষণার পর তারা একটি বই লেখেন- ‘দ্য চায়না স্টাডি’। এতে বলা হয় বিশ্বব্যাপী এত হৃদরোগ উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস স্থূলতার মূল কারণ হচ্ছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ।
লিভার ক্যান্সারের কারক প্রাণিজ আমিষ
কর্নেল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস প্রফেসর ডা. টি. কোলিন ক্যাম্পবেল ইঁদুরের দুটি গ্রুপের ওপর একটি গবেষণা চালান। দুটি দলকেই প্রতিদিন প্রাণিজ আমিষ খেতে দেয়া হতো- এক দলকে ৫ শতাংশের কম, আরেক দলকে ২০ শতাংশের বেশি। দুই গ্রুপের শরীরে সমান ডোজে ঢুকিয়ে দেয়া হয় আফলা টক্সিন।
উল্লেখ্য, আফলা টক্সিন হলো এক ধরণের শক্তিশালী কার্সিনোজেনিক এজেন্ট যা শরীরে ঢোকার পর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর দেখা গেল যেসব ইঁদুরকে ২০ শতাংশের বেশি প্রাণিজ আমিষ দেয়া হয়েছিল তাদের সবার লিভার ক্যান্সার হয়ে গেছে। আর যাদেরকে ৫ শতাংশের কম দেয়া হয়েছিল তাদের কারোরই লিভার ক্যান্সার হয় নি। টেস্টটি একাধিকবার করা হয়েছে, প্রত্যেকবার রেজাল্ট একই!
প্রাণিজ আমিষ খেতে সুস্বাদু হলেও স্বাস্থ্যের জন্যে মোটেই ভালো নয় (ছবিসূত্র- somoynews.tv)
ডা. ক্যাম্পবেল এই সিদ্ধান্তে আসেন, বিশ্বব্যাপী এত ক্যান্সার বাড়ার কারণ যতটা না কার্সিনোজেনিক এজেন্ট, তার থেকে বেশি হচ্ছে ‘নিরীহ’ এনিমেল প্রোটিন তথা প্রাণিজ আমিষ।
প্রাণিজ আমিষ খাব, না খাব না?
বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. মাইকেল গ্রিগারের বিখ্যাত বই- হাউ নট টু ডাই। এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হলো- আপনি যদি সুস্থ থাকতে চান তাহলে আপনাকে মূলত হোল ফুড প্লান্ট বেইজড ডায়েট খেতে হবে। মানে উদ্ভিজ্জ খাবার বেশি খেতে হবে। আম, আপেল বা কমলার জুস নয়, পুরো ফলটাই আস্ত খেতে হবে।
লাইফ স্টাইল এক্সপার্টরাও এই তথ্যের সাথে একমত হয়েছেন।
প্রাণিজ আমিষ পুরোপুরি বর্জন করবেন তা কিন্তু নয়! তবে গরু বা খাসীর বদলে মুরগী বা মাছ খান। আর সেটাও পরিমিত।
সাতদিন শাকসবজির পর একদিন খেতে পারবেন মাংস- স্রেফ খাদ্যবিজ্ঞানীরাই নন, বলছে আপনার দাঁতের প্রকৃতি আর পরিপাকতন্ত্রের গঠনও!