published : ২৭ জানুয়ারি ২০১৬
সুখী হতে কে না চায়? সুখের খোঁজে কত কী-ই না করে মানুষ। সুখের আকাঙ্ক্ষা যেন সার্বজনীন। কিন্তু সত্যিকারভাবে কজনই-বা এর দেখা পায়? গুণীজনেরা বলেন, সত্যিকারের সুখের ছটায় সবসময় ঝলমল করে ওঠে একজন মানুষের চেহারা, অভিব্যক্তি ও আচরণ। চলুন শোনা যাক, তেমনই একজন সুখী মানুষের গল্প-
ম্যাথু রিকার্ড। ৬৪ বছর বয়সী এ মানুষটি একসময় কাজ করেছেন অণুজীব বিজ্ঞানী হিসেবে। বর্তমানে তিনি একাধারে লেখক আলোকচিত্রী গবেষক অনুবাদক ও একজন ধর্মপ্রাণ ভিক্ষু। এতগুলো উপাধির সাথে তার নামের পাশে এখন যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের উপাধি। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত এটি।
রিকার্ডের চেহারাটা যেন একজন প্রশান্ত মানুষের মুখচ্ছবি। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক মানুষই পারে অফুরান আনন্দ আর সুখের অনুভূতিতে নিজের জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে। সহিষ্ণু দৃষ্টির এ মানুষটির ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি স্থান করে নিয়েছে সবসময়ের জন্যেই। রিকার্ডের এ নিরন্তর সুখের রহস্য কী? উত্তর একটাই-দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা।
২০০৪ সালে একাধিক ল্যাবরেটরি টেস্টের পর রিকার্ড পেয়েছেন বিশ্বসুখী মানুষের খেতাব। কয়েক ধাপবিশিষ্ট গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তার মধ্যে রয়েছে আনন্দপূর্ণ জীবনের এক অভাবনীয় ক্ষমতা। গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা তার পুরো মাথাটাকে মুড়ে ফেলেছিলেন ২৫৬টি ইলেকট্রোড দিয়ে। সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে তারা রিকার্ডের ব্রেনের ওপর মেডিটেশনের প্রভাব অনুসন্ধান করতে থাকেন।
গবেষণা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীদের সামনে যে জিনিসটি উন্মোচিত হয়েছে, সেটি এককথায় দারুণ চমকপ্রদ। রিকার্ড এবং অন্যান্য ধ্যানমগ্ন ভিক্ষুর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অত্যন্ত সুতীক্ষ্ণ। উল্লেখ্য, মানুষের তৃপ্তি, সুখ আর আনন্দের মতো ইতিবাচক আবেগগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের এ অংশটি থেকেই।
৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মেডিটেশন চর্চা করছেন ম্যাথু রিকার্ড। যার ফলে তিনি এখন তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তার ভাষায়, মেডিটেশন স্থায়ী ও অনন্ত সুখের মূল উপাদান। A Guide to Developing Life's Most Important Skill বইতে সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রিকার্ড লিখেছেন, সুস্থ সুন্দর মন থেকে উৎসারিত এক গভীর অনুভূতিই হলো সুখ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ বইটি পরবর্তীতে বেস্ট সেলার-এর সম্মান লাভ করে। মূলত সুখ নিয়ে তার অনুভূতি উপলব্ধিগুলোই রিকার্ড তুলে ধরেছেন এ বইটিতে।
দেশ থেকে দেশে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন সুখের গূঢ় তত্ত্ব। গভীর আগ্রহে এ সুখী মানুষের কথা শুনতে আসেন ছাত্র থেকে করপোরেট পেশাজীবীসহ সব ধরনের মানুষ। সহজ ভাষায় সৌম্য ভঙ্গিতে তিনি বলে চলেন-‘সুখ হচ্ছে এমন এক প্রশান্ত অনুভূতি, যা অযাচিত সব দুঃখ অশান্তি আবেগকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়....’।
রিকার্ড বলেন, সুখের জন্যে আমরা চারপাশের অনেক কিছুতে অবলম্বন খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আসলে এর সন্ধান করা উচিত নিজের অন্তর্গত আনন্দলোকে। আমি বিশ্বাস করি, সুখী হওয়ার একমাত্র উপায় এটাই। আর আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন-চারপাশে কী ঘটছে তা মোটেও বিবেচ্য নয়, বরং পারিপার্শ্বিক এ ঘটনাগুলোকে আমরা কীভাবে দেখছি অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই নির্ভর করে জীবনের সুখ ও আনন্দ।
আসলে বিষয়টি এমন যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা যা-ই হোক, আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে সুখী হওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। এর জন্যে আগে আমাদের মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। জানতে হবে এর উপায়। কারণ শারীরিক-মানসিক সুস্থতা, নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন-এ সবকিছুর জন্যেই মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি।
শরীরের সুস্থতা ও সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্যে প্রতিদিন আমরা কত কী-ই না করি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, সেদিকেই আমাদের মনোযোগ সবচেয়ে কম। তা হলো-নিজের মনের দিকে তাকানো, মনের যত্ন নেয়া। আসলে মনের প্রতি, অন্তর্গত অস্তিত্বের প্রতি এ মনোযোগই আমাদের উপলব্ধিগুলোকে আরো শাণিত করে তোলে। নিরন্তর সুখের দেখা পাই আমরা। আর এর সবচেয়ে কার্যকরী প্রক্রিয়াটি হলো মেডিটেশন। দিনে আধঘণ্টা মেডিটেশন আপনাকে পৌঁছে দেবে এক আশ্চর্য সুখানুভূতির রাজ্যে।
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটে চলেছে তা কিন্তু আমাদের দুঃখের কারণ নয়, বরং এসব ঘটনায় আমরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, মূলত তা-ই আমাদেরকে অসুখী করে তোলে। এ প্রসঙ্গে রিকার্ডের উপলব্ধি- ‘পৃথিবীর সবকিছুকে আমি কখনোই নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে ফেলতে পারবো না কিন্তু নিজের মনটাকে তো পরিবর্তন করতে পারি আমি। আর যিনি নিজের মনকে পরিবর্তন করতে পারেন অর্থাৎ নিজেকে বদলাতে পারেন তিনি পৃথিবীটাকেই পারেন বদলে দিতে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুখের পেছনে ছোটা এবং ক্রমাগত এভাবে ছুটতে থাকা আধুনিক মানুষের একটি অবসেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা যেন পারিপার্শ্বিক সব অযাচিত আবেগ-অনুভূতির সাথে যুদ্ধে পরাভূত হচ্ছি। তাই সুখী হওয়ার জন্যে রিকার্ডের পরামর্শ-ভেতরে কৃতজ্ঞতাবোধ সন্তুষ্টচিত্ততা কল্যাণকামিতা লালন করুন। আপনি সুখী হবেন। শুধু মনোরম আর সুখপ্রদ অভিজ্ঞতার পেছনে ছুটলেই আপনি সত্যিকারের সুখী হতে পারবেন না। কারণ, সুখী হওয়াটা নির্ভর করে কিছু মানবিক আচরণের ওপর যেমন : উদারতা, পরার্থপরতা, সমমর্মিতা, অন্তর্গত শক্তি। সেইসাথে চাই প্রশান্ত মন। আর আনন্দময় সুখের পথে সবচেয়ে বড় হুমকি হলো অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা। তাই সুখী হতে হলে সমমর্মী ও অন্যের কল্যাণকামী হোন সবার আগে। এভাবেই শুরু হবে আপনার সুখযাত্রা।
‘বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ’ উপাধিটি এমন জাঁকালো আর দশাসই হলেও ম্যাথু রিকার্ডের বার্তাটি কিন্তু খুব সরল। যা সহজেই বোধগম্য এবং অনুসরণযোগ্য। তা হলো-দয়ালু হোন, নিঃস্বার্থ মমতায় প্লাবিত করুন নিজের অন্তর। অন্তর্গত শক্তি, উদারতা আর কৃতজ্ঞতাবোধে পূর্ণ হোক আপনার সমগ্র অস্তিত্ব। নিয়মিত ধ্যানমগ্ন হোন। সত্যিকারের সুখের দেখা মিলবেই।