published : ২ নভেম্বর ২০২১
ফেসবুক-গুগলদের মনে করা হয় প্রযুক্তিবিদদের স্বর্গ। দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইটি কোম্পানিগুলোতে বলাই হয় যে, এত ভালো কাজ শেখো যেন জীবনে একদিন ফেসবুক-গুগলে চাকরি নিতে পারো!
অর্থাৎ, এ-সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যেন বিশাল ব্যাপার!
আকর্ষণীয় বেতন, অসামান্য প্রেস্টিজ। কর্মীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা, আর শেখার অপূর্ব সুযোগ। এ-কারণে আমাদের দেশের কোনো শীর্ষ মেধাবী যখন সেখানে নিয়োগ পায় তখন পত্রপত্রিকায় তাদের নামধাম ফলাও করে ছাপা হয়। আমরা পড়ি, গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে।
এ-সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাওয়া কিন্তু খুব বিরল ব্যাপার না। বাংলাদেশের অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণীই এ-সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ভারত, চীন থেকেও আছে অনেকে।
কথায় বলে, এশীয়দের নাকি গণিতের মস্তিষ্ক খুব ভালো। তাই আমরা ধরেই নেই যে আমাদের ব্রেন শার্প বলেই বুঝি এত সমাদর করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে তারা। আসল কারণ কিন্তু ভিন্ন!
১৯৯০ সালে আমেরিকায় H-1B ভিসা চালু করা হয়, এবং নির্দিষ্ট করা হয় যে মোট ৬৫০০০ কর্মী আনা যাবে এর মাধ্যমে। কিন্তু ২০১৩ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩০০,০০০-এ!
একই দক্ষতার একজন আমেরিকানকে যে বেতন দিতে হয়, যদি তৃতীয় বিশ্ব থেকে কর্মী আনা যায় তাহলে অর্ধেক বেতন দিলেই চলে। আবার, যেহেতু সেই কর্মীর আমেরিকায় বসবাস সম্পূর্ণ কোম্পানির আবেদনে বিশেষ ভিসা দ্বারা হয়েছে, যদি কোম্পানি তাকে চাকরীচ্যুত করে তাহলে সেই কর্মীকে সাথে সাথে দেশে ফিরে যেতে হবে। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলো এই কর্মীদের ইচ্ছেমতো খাটাতে পারে বছরের পর বছর।
অবস্থা এমন- H-1B ভিসায় আসা কর্মীদের প্রমোশন দেয়ার দরকার নেই, তাদের শুধু গ্রিন কার্ড দেবে এই লোভ দেখাও!
জাপানি বংশদ্ভূত আমেরিকান প্যাট্রিক শু গুগল ও ফেসবুকে কাজ করেছেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এসব প্রতিষ্ঠানে তার কাজের অভিজ্ঞতা বিষয়ে কথা বলেন তার ইউটিউব চ্যানেল টেক লিডে Are Facebook employees depressed? (H1B slavery visa & abuse) শীর্ষক ভিডিওতে। তার কথার কিছু অংশ তুলে ধরা হলঃ
“বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কর্মীরা সেখানে বুঝি স্বপ্নের চেয়েও ভালো আছে! খুব ফ্রি ফ্রি কফি আইসক্রিম খাচ্ছে, অনেক টাকা বেতন পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেখানে বেশিরভাগই দাস ছাড়া আর কিছু না। এটা কোনো গোপন তথ্য নয় যে টেক ইন্ডাস্ট্রি প্রাতিষ্ঠানিক দাসত্বকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে H-1B ভিসার মাধ্যমে।
তুমি কম পয়সায় কর্মী আমেরিকায় নিয়ে আসবে, যারা তোমার ভিসা ছাড়া আসার সুযোগ পেত না। এরপর এরা পুরোপুরি তোমার আওতাধীন!
এদের পারফরমেন্স যদি তোমার পছন্দ না হয়, তো তুমি যে কোন সময় তাদের চাকরীচ্যুত করতে পারবে; এরপর সাথে সাথে আমেরিকা থেকে বিতাড়িত হতে হবে- এই ভয়ে এরা নাওয়া-খাওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি সব বাদ দিয়ে দিনরাত কাজ করবে। কারণ এ ছাড়া এদের আর কোন উপায় নেই!
সিলিকন ভ্যালির বেশিরভাগ কোম্পানির নীতি হচ্ছে- নিয়োগ কর, বিয়োগ কর, হাজার হাজার দাস আনো! সেখানে প্রচুর কোম্পানি আছে, যার চৌহদ্দিতে পা রাখতেই তোমার মনে হবে তুমি তৃতীয় বিশ্বে চলে এসেছ! সেটা যেন একটা বেতনভুক্ত দাসের কারখানা। সেখানকার উচ্চপদস্থরা ভালো করেই জানে, এই কর্মীদের দিয়ে যত খুশি কাজ করানো যাবে।
আমি এর আগে Groupon-এ কাজ করতাম; সেখানে H-1B ভিসা নিয়ে যারা এসেছে ম্যানেজাররা তাদেরকে কোনো সম্মান দেয় না। আমেরিকান হওয়ায় আমার যখন খুশি চাকরি ছাড়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু আমার সহকর্মীরা এতটা ভাগ্যবান ছিল না। তারা বছরের পর বছর শুধু দাসত্বই করে যাচ্ছে।
তারা নানান কসরত বের করে কীভাবে ছুটির দিনেও কর্মীদের খাটানো যায়। কর্মীদের তারা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কাজ করায়।
তুমি হয়ত বলবে, ছুটি নিলেই তো হয়! ছুটি নেয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু এতে তোমার পারফর্মেন্স নেমে যাবে।
সেখানে ম্যানেজারদের দেখে মনে হবে যেন সত্যি তারা তোমাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছে! কিন্তু সত্য হচ্ছে যে তুমি ভালো পারফর্ম করলে তোমার ম্যানাজার ভালো গ্রেডিং পাবে।
পারফর্ম করবে তুমি, আর সুযোগ-সুবিধা পাবে তোমার ম্যানেজার। কিন্তু তুমি যদি ভালো না করো তার জন্যে তুমিই বহিষ্কৃত হবে, ম্যানেজারদের কিছু হবে না।“
পৃথিবীর ইতিহাসে আগেও এমনটা হয়েছে। তবে আগে দাস বানানো হতো সাধারণদের, আর এখন বানানো হচ্ছে মেধাবীদের। যার মাধ্যম হলো লোভনীয় চাকুরির অফার। গুগলের ভারতীয় বংশদ্ভূত সিইওকে দেখে আমরা ভাবি, এই চেয়ার হয়ত আমরাও পাবো!
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বাহ্যিক চাকচিক্য, ব্রান্ড ভ্যালু ইত্যাদির মোহে আমাদের অনেক তুখোড় মেধাবী H-1B ভিসার মাধ্যমে পাড়ি জমাচ্ছে এমন এক অনিশ্চয়তার দিকে, যেখানে না আছে সম্মান, না আছে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ। আছে কেবলই দাসত্বপূর্ণ জীবন।
আরো পড়ুন:-