published : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষ জীবন শুরু করতে চায় হয় অতীত থেকে, নয়তো ভবিষ্যত থেকে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীত কিংবা অনাগত ভবিষ্যত থেকে জীবন শুরু করা যায় না। জীবন সবসময় শুরু করতে হয় বর্তমান থেকে অর্থাৎ যা আছে তা নিয়ে। এটিই গ্রাউন্ড জিরো। যা আপনার নেই কখনো কখনো সেটিই আপনার জন্যে বাড়তি সুবিধা বা প্লাসপয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে- যদি আপনি জানেন যে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে করতে হয়।
কিন্তু আমরা বারবার ব্যর্থতার একই বৃত্তে জড়িয়ে পড়ি- কয়েকটি ভুলের কারণে। একটি গল্পের মধ্য দিয়ে ঐ ভুলগুলোকে খুব সুন্দরভাবে আমরা তুলে ধরতে পারি:
এক শিকারির জালে এক টুনটুনি ধরা পড়ল। নিজের জীবন বাঁচাতে টুনটুনি শিকারিকে বলল, আমি খুব ছোট, আমাকে দিয়ে তোমার পেট একটুও ভরবে না। বরং আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে তিনটি জ্ঞানের কথা শোনাব। প্রথমটা তোমার হাতে বসে, দ্বিতীয়টা সামনের ডালে এবং তৃতীয়টা বলবো মগডালে গিয়ে। টুনটুনির প্রথম উপদেশ ছিল, অলীক কথা যদি কেউ বলে তা বিশ্বাস করবে না। শিকারি বলল, এটা তো আমিও জানি। পাখি বলল, ঠিক, জানো, কিন্তু জানাটা খুব বড় বিষয় নয়, যা তুমি জানলে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করাটাই বড় বিষয়। একথা বলে শিকারির হাত থেকে উড়ে সামনের ডালে গিয়ে বসল। দ্বিতীয় উপদেশ : কী হতে পারত, কী হলে কী করতে বা যা তুমি হারিয়েছো অর্থাৎ যা অতীত হয়ে গেছে, আর ফিরে পাওয়া যাবে না তা নিয়ে আফসোস করো না। শিকারি বলল, তা আমি করি না। এরপর পাখি বলল, আমি কিন্তু সাধারণ পাখি নই। আমার পেটে মুক্তো রয়েছে যা মুরগির ডিমের সমান। তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না দিয়ে আমার পেট কাটতে তাহলে মুক্তোটি পেতে এবং ধনী হয়ে যেতে পারতে।
মুক্তো হাতছাড়া হওয়ার দুঃখে শিকারি আফসোস ও বিলাপ শুরু করল। পাখি বলল, বলেছিলাম না যে, তুমি উপদেশ অনুসরণ কর না। উপদেশ জানা আর মানা এক বিষয় নয়। তুমি তো এখন আফসোস করছো। শিকারি বলল, কিন্তু এই যে মুক্তো হাতছাড়া হয়ে গেল! পাখি বললো, বলেছিলাম, কারো কোনো অলীক অবাস্তব বা অসম্ভব কথায় বিশ্বাস করবে না। আমি একটা ছোট্ট টুনটুনি, আমার পেটে মুরগির ডিমের সমান মুক্তো থাকবে কীভাবে? শিকারি বললো, তাইতো! এভাবে তো ভেবে দেখি নি। এবার তোমার তৃতীয় উপদেশটি দাও। পাখি মগডালে গিয়ে বলল, হতভাগা, দুর্দশাগ্রস্ত ও মূর্খরা কখনো জ্ঞানীর কথা শোনে না। তারা শিখতে চায় না। তাই তারা প্রতারকদের অলীক কথায়, চালবাজদের চালবাজিতে আর শোষকদের ভয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের জীবন অলীক কল্পনা অথবা ভয়ে, আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায় শেষ হয়ে যায়। তারা দরিদ্র এবং বঞ্চিতই থেকে যায়। আমার প্রথম ও দ্বিতীয় উপদেশ থেকে তুমি কোনো শিক্ষা নাও নি, তাই তৃতীয় উপদেশ শুনে আর কী করবে বল।
মানুষের জীবনে প্রথম চোরাবালিই হচ্ছে অলীক কল্পনা। শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ ছোটবেলায় চিন্তা করে, আমার মা-বাবা যদি অমুকের মতো হতো! বা যদি বড় ঘরে জন্মাতাম কিংবা অমুকের ছেলে বা অমুকের মেয়ে হতাম অথবা অমুক বিখ্যাত ব্যক্তির ভাই বা বোন হতাম তাহলে কতই না ভালো হতো, কত কিছুই না করতে পারতাম। অনেকে ভাবে, আহারে যদি ভালো রেজাল্ট করতে পারতাম, যদি ওখানে ভর্তি হতে পারতাম! এই যে ‘যদি এটা হতো’ এবং ‘যদি ওটা হতো’ এগুলোই হলো অলীক কল্পনা। এটি হচ্ছে জীবনের প্রথম চোরাবালি- যেখানে মানুষ আটকে যায়।
মানুষ যখন অলীক কল্পনা করে তখন তার মস্তিষ্ক এই অলীক কল্পনাকে বাস্তব মনে করে এবং সে এক ধরনের সুখানুভূতির মধ্যে থাকে। সে বসে বসে ভাবে, এই হলে এই হতো। কিন্তু আসলে পুরোটাই শূন্য। এ ধরনের ভাবনায় ক্ষণিকের সুখ সৃষ্টি হয় এবং মানুষ তার মধ্যে হারিয়ে যায়। তখন তার ব্রেন এ অলীক কল্পনাকেই বাস্তব মনে করে এবং যখন আবার সে বাস্তবে ফিরে আসে তখন এ সুখানুভূতি আর থাকে না। বরং তখন আফসোস ও হা-হুতাশের বৃত্তে সে ঘুরপাক খায়। সে তখন আর এগুতে পারে না।
এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো: মনছবি আর অলীক কল্পনা কিন্তু এক নয়। অলীক কল্পনা হচ্ছে স্রেফ কল্পনা, যা ব্যক্তি নিজেই বিশ্বাস করে না। ফলে নিজের ভেতর সে কোনো কর্মস্পৃহা অনুভব করে না। কারণ অলীক কল্পনাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে না। কিন্তু মনছবি তা নয়। মনছবি হলো বিশ্বাসের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া।