ফেসবুক গুগল অ্যাপল : জরিপে উঠে আসা সেরা কর্মক্ষেত্রগুলোর বাস্তবচিত্র

পৃথিবীর সেরা কর্মক্ষেত্র কোনটি- নামীদামী জার্নালগুলো প্রায় প্রতিবছরই করে এই র‍্যাংকিং। কিন্তু যে জরিপের ফলাফল থেকে এই র‍্যাংকিংগুলো করা হয় তা কি বাস্তবচিত্র থেকে নেয়া, নাকি এটা ইমেজ তৈরির জন্যে পেইড প্রমোশন বা বিজ্ঞাপনী প্রচারণা?

আসুন, কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীন কর্মীদের বরাতে কিছুটা জানার চেষ্টা করি।

গুগল

কাজের জন্য সেরা ১০০ কোম্পানি- ২০১৬ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের এই তালিকায় ১ নম্বরে ছিল গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেট। আর ২০১৮ সালে প্রখ্যাত রিভিউ প্লাটফর্ম গ্লাসডোরের ‘বিশ্বে কাজের জন্য সেরা কোম্পানির তালিকায়’ গুগল ছিল ৫-এ।

অথচ সে বছরের ১ নভেম্বর গুগলের ২০ হাজার কর্মী কোম্পানিটির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে কাজের বিষাক্ত পরিবেশ, যৌন হয়রানী, লিঙ্গ বৈষম্য, অসদাচরণ, স্বচ্ছতার অভাব, বর্ণবাদী আচরণ- এমন বহু অভিযোগ নিয়ে। তাদের বক্তব্য হলো তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগের পর অভিযোগ দিয়েও কোনো ইতিবাচক সাড়া পায় নি।

গুগলের একজন আন্দোলনরত কর্মী জানান, “গুগল অফিস কালচারের জন্য বিখ্যাত; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা এখানে মৌলিক সম্মানটুকুও পাই না। এখানে প্রত্যকের জন্য ন্যায় এবং সুবিচার নেই!”

ফেসবুক

উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা নিয়ে ফেসবুকে জয়েন করার পর তাতে ভাঁটা পড়তে সময় লাগে না অনেকেরই। প্রতিষ্ঠানটির একজন সাবেক কর্মী দ্যা গার্ডিয়ানকে জানান,

“আমার জীবনে সবচাইতে বিষাক্ত অভিজ্ঞতা ছিল ফেসবুকে কাজ করা! সেখানের টিমগুলোতে অসাধারণ মেধাবীরা আছে ঠিকই; কিন্তু সেই সাথে আছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, হুমকি, পক্ষপাত লিঙ্গ বৈষম্য।

ফেসবুকের সাবেক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্যাট্রিক শ্যুর ভাষ্যমতে, সেখানে কর্মীদের নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটিতে কাজ করতে হয়। এখানে ম্যানেজারদের ট্রেনিং দেয়া হয় যেন তারা কর্মীদের মাইক্রোম্যানেজ এবং হয়রানির উপর রাখে।

ফেসবুকের একজন কর্মীর অফিসেই আত্মহত্যা করার প্রেক্ষিতে মি. শ্যু বলেন -

“এই কর্মীকে ফেসবুক দুর্বল পারফরম্যান্স দেখাচ্ছিল, এবং যে-কোনো সময় তার চাকরি চলে যে পারে- এই আতঙ্কে সে ছিল।"

ফেসবুকের কয়েকজন কর্মী জানান, অনেক সময়ই তারা নিজেদের ওয়ালে অফিসের আলো ঝলমলে ছবি পোস্ট করেন, কর্ম পরিবেশ নিয়ে ভালো ভালো কথা লেখেন- বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তা আসলে ম্যানেজারদের তুষ্ট করার জন্যে!

ফেসবুকে কর্মীদের দক্ষতা মূল্যায়ন হয় ‘স্ট্যাক র‍্যাঙ্কিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে

পদ্ধতিটা হলো- ৮৫% কর্মীকে ভালো ক্যাটাগরিতে ফেলতে হবে এবং বাকি ১৫% কর্মীকে ফেলতে হবে দুর্বল ক্যাটাগরীতে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরির কর্মীরা হয় ছাঁটাই হবে, নতুবা তারা আর কখনো প্রমশনের সুযোগ পাবে না।

১৫% কর্মী দুর্বল থাকুক বা নাই থাকুক, তাদেরকে দুর্বল ক্যাটাগরিতে পড়তেই হবে। কেউ নিজ থেকে চলে যেতে চাইলে তাকে পড়তে হয় আরও বিপাকে। কারণ এ-ধরণের কর্মীদের ফেলা হয় ‘অনুশোচনীয়’ এবং ‘অনুশোচনীয় নয়’- এই দুটি ক্যাটাগরিতে। ‘অনুশচনীয় নয়’ ক্যাটাগরিতে পড়া মানে সিলিকন ভ্যালিতে অন্যান্য টেক জায়ান্টে কাজ করার সুযোগ সীমিত হয়ে আসা।

অবাক ব্যাপার হলো, কর্মীদের এতটা মানসিক চাপে রাখার পরও গ্লাসডোরে ফেসবুক দুইবার সেরা কর্মক্ষেত্র হিসেবে শীর্ষস্থান অর্জন করে!

অ্যাপল

প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদনে একজন কর্মী বলেন-

“মানসিক রোগের জন্যে আমাকে আগে কখনো ডাক্তারের বিল গুনতে হয়নি। কিন্তু ১০ বছর অ্যাপলে কাজ করে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমি দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। যতবার আমি এই মানসিক রোগের ওয়ার্ডে গিয়েছি ততবারই অ্যাপলের কোনো না কোনো কর্মীকে সেখানে দেখেছি!”

আরেকজন কর্মী জানান, ৬ বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে তার মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে, এবং তিনি এতটা ডিপ্রেশনে পড়ে যান যে ৪ মাস বাড়িঘর ছেড়ে পার্কে এবং হাইওয়েতে রাত কাটান।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের নিয়ে বিজনেস ইনসাইডার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে

এতে উঠে আসা কর্মস্থল সম্পর্কে তাদের কিছু অভিজ্ঞতা–

“ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নেই, ছুটিতে গেলে সেটা ভালো চোখে দেখা হয় না”

“প্রচুর ওভারটাইম! পরিবার আছে এমন কারও জন্য এটা কর্মস্থল না!”

“পরিবারের ইমার্জেন্সিতেও কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না”

“যে বেতন দেয়া হয় তা কাজের তুলনায় কিছুই না!”

একজন তরুণ মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার তুমুল উৎসাহ নিয়ে অ্যাপলে জয়েন করার পর তার অভিজ্ঞতা দাঁড়ায় এরকম- “আমার কাজটা বোরিং হয়ে গেছে, কারণ তারা সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেয় না। তাদের নীতি একটাই- ম্যানেজমেন্ট ইতিমধ্যেই তোমার জন্য যে কাজ ঠিক করে রেখেছে, তুমি শুধু সেটা করে যাবে!”

অর্থাৎ মেধাবিকাশের সুযোগ নেয়ার অপশন সেভাবে নেই এই প্রতিষ্ঠানে।