রমজানে ফুড ফাস্টিংয়ের পাশাপাশি হোক ডিজিটাল ফাস্টিংও!

বছর ঘুরে আবারো এসেছে মাহে রমজান!

এ-মাস দেহশুদ্ধি ও আত্মশুদ্ধির চমৎকার সুযোগ যেমন নিয়ে আসে, তেমনি তা হতে পারে ভালো কিছু অভ্যাস গড়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগও।

গ্যাজেট বা ভার্চুয়াল ভাইরাসের কথাই ধরা যাক!

দিনকে দিন আমাদের ‘স্ক্রিন টাইম’ যেভাবে বাড়ছে তাতে খুব দ্রুত নিজেদের সামলে না নিলে অদূর ভবিষ্যতে সম্মুখীন হতে হবে কঠিন বাস্তবতার।

তাই এবারের রমজান আপনার জন্যে শুধু ফুড ফাস্টিং-ই নয়, হতে পারে ডিজিটাল ফাস্টিংয়েরও সেরা সময়!

কী এই ‘ডিজিটাল ফাস্টিং’?

ফাস্টিং মানে তো আমরা জানিই- উপবাস বা কোনোকিছু থেকে বিরত থাকা। ‘ডিজিটাল ফাস্টিং’ হলো গ্যাজেট ব্যবহার থেকে সচেতনভাবে কিছু সময়ের জন্যে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা।

এ-জন্যে প্রয়োজন একটি শিডিউল তৈরি করা, যখন আপনি সচেতনভাবে সব ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস বা গ্যাজেট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন, তা হোক স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা আইপ্যাড।

নিদিষ্ট সময়ের জন্য সকল ধরনের গ্যাজেট থেকে দূরে থাকা-ই ‘ডিজিটাল ফাস্টিং’ (ছবিসূত্র- dreamstime.com)

এই প্রক্রিয়ার আরেক নাম ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ (digital detox)।

ডিটক্স মানে আসক্তিযুক্ত বিষাক্ত/ক্ষতিকর কাজ বা অভ্যাস পরিত্যাগ করা। এই যে আমরা না চাইতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে সম্মোহিত অবস্থায় আছি, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব ডিজিটাল ডিটক্সের মাধ্যমে।

কেন দরকার ডিজিটাল ফাস্টিং?

রমজান মাসে ফাস্টিং বা উপবাস বলতে অধিকাংশ মানুষই বুঝে থাকেন স্রেফ পানাহার থেকে বিরত থাকা। তবে রমজানে সংযম কেবল খাবার থেকে বিরত থাকার নাম নয়; বরং গীবত, পরনিন্দা-পরচর্চা, মিথ্যা, বিতর্ক, অপপ্রচার, অশ্লীলতা, খারাপ চিন্তা-কুচিন্তাসহ সকল অন্যায় থেকে বিরত থাকা রমজানে অন্যতম সংযম।

ভাবছেন এসবের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া বা স্মার্টফোনের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে!

চিন্তা করে দেখুন তো, সোশ্যাল মিডিয়ায় কমেন্ট সেকশনে কয়টি ইতিবাচক বা ভালো কথা দেখা যায়? একজন ভালো কোনো কথা বললেও দশজন হয়তো নেতিবাচক কমেন্ট করছে বা অহেতুক বিতর্কে জড়াচ্ছেন।

আর ফিতনা-ফাসাদে জড়ানো, অহেতুক অনর্থক কথা বলা, কারো সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক বা বিদ্রূপাত্মক কথা বলা– এর সবই রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী।

গ্যাজেট খাচ্ছে আপনার মূল্যবান সময়!

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর কিছু তথ্য।

  • বর্তমানে একজন মানুষের ‘স্ক্রিন টাইম’ দিনে গড়ে প্রায় ৭ ঘণ্টা!
  • ২৪ ঘণ্টায় মানুষ ফোন স্পর্শ করে গড়ে ২,৬১৭ বার!
  • একজন মানুষ সারাদিনে যতক্ষণ সজাগ থাকে, তার ৪৪ ভাগ সময়ই কোনো না কোনো স্ক্রিনের সামনে থাকে!

এত দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে কাটালে কী ক্ষতি হয়?

মনোযোগ বিক্ষিপ্ততা, ডিপ্রেশন, হতাশা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, আসক্তি, ইনসমনিয়া, ক্ষুধামন্দা, ধৈর্যহীনতা- সমস্যার শেষ আছে!

সময় অপচয়ের ‘সেরা’ মাধ্যম এখন স্মার্টফোন! (ছবিসূত্র- rentacenter.com )

গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে মাত্র ১৯ সেকেন্ড মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের অবস্থাও শোচনীয়। অফিসে যারা কাজ করেন তারা সর্বোচ্চ তিন মিনিট একটি কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন!

তাছাড়া দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময় ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকলে কর্মক্ষমতা কতটা হ্রাস পায় তা তো সহজেই অনুমেয়! ডিজিটাল ফাস্টিংয়ের তাই বিকল্প নেই।

গেল বছর জৈনদের যে অভিনব কাজটি বেশ আলোচিত হয়

ভারতের জৈন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব পর্যুসান পর্ব।

৮ দিনব্যাপী এই উৎসবের উদ্দেশ্য হলো পূজা-অর্চনা ও উপবাসের মধ্য দিয়ে আত্মিক মুক্তি ও আত্মশুদ্ধি অর্জন। রীতি অনুযায়ী নিজের পছন্দের কোনোকিছু থেকে এই সময়টা বিরত থাকতে হয়।

২০২২ সালে পর্যুসান পর্ব পালনের সময় মধ্যপ্রদেশে জৈন সম্প্রদায়ের প্রায় হাজার খানেক অনুসারী এক অভিনব পন্থা বেছে নেন। পুরো ২৪ ঘণ্টার জন্যে তারা নিজেদের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ সমস্ত গ্যাজেটস মন্দিরে জমা রেখে ডিজিটাল ফাস্টিং পালন করেন।

পর্যুসান পর্বে অংশগ্রহণকারীরা তাদের স্মার্টফোন জমা রাখছে (ছবিসূত্র- এনডিটিভি)

ডিজিটাল আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় হিসেবেই এই পদ্ধতি বেছে নেন তারা।

শুরু করবেন যেভাবে

ফুডফাস্টিংয়ের মতো ডিজিটাল ফাস্টিংয়ের জন্যেও খুব অনুকূল সময় হলো মাহে রমজান। কাজটা বেশ সহজও।

সারাদিনে কতক্ষণ আপনি ডিভাইজ ব্যবহার করবেন তা নিজেই ঠিক করে নিন।

বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি কোম্পানি Intel কর্মীদের জন্যে কর্মসময়ে চার ঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে; এই সময়ে তারা কোনো স্মার্টফোন ব্যবহার করবে না, ল্যাপটপে ইমেইল বা ফেসবুক চেক করবে না।

আপনিও নিজের জন্যে ঠিক করে নিন যে কাজের সময় কমসে কম চার ঘণ্টা আপনি স্মার্টফোন বন্ধ রাখবেন।

আরো ভালো হয় যদি ঠিক করে নেন দিনের কখন কখন কতক্ষণ আপনি স্মার্টফোন খোলা রাখবেন। ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেজে যা যোগাযোগ তা সেই সময়ে করুন। বাকি সময় স্মার্টফোন থাকবে বন্ধ।

কোয়ান্টাম সদস্যরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই ডিজিটাল ফাস্টিং করছে!

রাত ১১টায় সব ধরণের স্ক্রিন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করা পরিণত হয়েছে তাদের অভ্যাসে। আপনি যদি এখনো এই চর্চা শুরু না করে থাকেন তাহলে আজ থেকেই শুরু করুন। রাত এগারটা বাজতেই সব ধরণের ডিজিটাল ডিভাইজ বন্ধ করে দিন।

আর, সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই স্মার্টফোনে চোখ মেলার অভ্যাস থাকলে তা ছাড়ুন এখনই।

শুরুতে বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে কাজটা। কারণ বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই ‘মি টাইম’ হিসেবে বেছে নেন গভীর রাতের সময়টিকেই।

তবে যেহেতু রমজানে সেহরিতে ওঠার নির্দিষ্ট সময় আছে বিধায় সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হয়; তাই রাত এগারটার মধ্যে ডিভাইজ ব্যবহার বন্ধ করা এখন বেশ সহজ। পুরো একটা মাস চর্চায় কাজটি পরিণত হবে অভ্যাসে। রমজান শেষেও এই অভ্যাস জারি রাখা হবে সহজ, যদি আপনি চান!