ভুলে যাওয়ার প্রবণতার মহামারি 'ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া'; বেঁচে থাকতে করণীয়

published : ৬ জুলাই ২০২৪

ল্যান্ডফোনের যুগে, যখন ফোন নম্বর মুখস্থ করে করে ডায়াল করতে হতো, অনায়াসেই ১০/১২টা ফোন নম্বর মুখস্থ বলে দিতে পারতো অনেকে। কিন্তু এখন? দুটো ফোন নম্বর মুখস্থ বলতে পারে এমন মানুষও পাওয়া কঠিন! মনে রাখার প্রয়োজনও অবশ্য পড়ছে না কারণ হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনই মুখস্থ রাখছে সব নম্বর। 

শুধু কি ফোন নম্বর? জরুরি অনেক তথ্য নোট নেয়া, বাজারের লিস্ট টুকে রাখা, গুরুত্বপূর্ণ তারিখ সেভ রাখার কাজগুলো এখন অনায়াসে করা যাচ্ছে স্মার্ট ডিভাইজ ও অ্যাপসের মাধ্যমে। আর এর ফলে অজান্তেই নিজেদের ক্ষতি করছি আমরা, আক্রান্ত হচ্ছি ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ায়। 

'ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া' কী? 

অ্যামনেশিয়া অর্থ স্মৃতি হারানো। ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া হলো ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর অতি নির্ভরশীলতার কারণে স্মৃতি মনে রাখতে না পারার প্রবণতা।

প্রয়োজনীয় ছোটখাট তথ্য মনে রাখার জন্যে যখন আমরা ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছি তখন মস্তিষ্কের আর বাড়তি কষ্ট করার প্রয়োজন পড়ছে না। এতে ডিভাইসের কাজ তো বাড়ছে, কিন্তু কমে যাচ্ছে মস্তিষ্কের দায়িত্ব।

মস্তিষ্ক এতটাই অলস হয়ে পড়ছে যে দুঃসময়ে ইমার্জেন্সি ফোন নম্বরও মনে থাকছে না। প্রয়োজনের মুহূর্তে জরুরি তথ্যের জন্যে হাতড়াতে হচ্ছে গুগল কিপ, নোট বা ফোনের স্টিকি নোটস। তথ্য ভুলে যাওয়ার এই সমস্যাকেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন 'ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া'।  

কেন হয় ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া?

মানুষ জ্ঞান আহরণ করে ইন্দ্রিয়, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু চারদিকে এত ডিজিটাল তথ্যের সমারোহ যে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের দিকে মনোযোগ দেয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে মস্তিষ্ক দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি গঠনের সুযোগ পায় না। 

যখনই আমরা স্মার্টফোন বা সার্চ ইঞ্জিন থেকে কোনো তথ্য নেই, আমাদের মস্তিষ্ক ধরেই নেয় যে সেই তথ্যটা মস্তিষ্কের নিজস্ব স্টোরেজে রাখার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, সে স্মার্ট ফোন বা ডিভাইসকে মনে করা শুরু করে মস্তিষ্কের 'এক্সটারনাল স্টোরেজ'। মস্তিষ্ক তখন নিজের স্মৃতিতে জায়গা না করে বাইরের স্টোরেজ ব্যবহারকেই সুবিধাজনক মনে করে।

এতে মস্তিষ্কের কাজ কমে যায়, মস্তিষ্ক অলস হয়ে পড়ে। দেখা দেয় ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। 

গবেষণা কী বলছে?

২০১৫ সালে ক্যাসপারেস্কি ল্যাব ছয় হাজার প্রযুক্তি ব্যাবহারকারীর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখে যে, তথ্য যখন সহজে পাওয়া যায় তখন বেড়ে যায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। প্রযুক্তি-নির্ভরতার ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে শুরু করে। তারাই প্রথম এই রোগের নামকরণ করেন ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। 

ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহামের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, বর্তমানে মানুষ তথ্য আত্মস্থ করার পরিবর্তে সেগুলো সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজে বেশি। আর যেসব তথ্য সার্চ ইঞ্জিনে সহজে পাওয়া যায় তা মানুষ সহজে ভুলেও যায়। সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজার এই প্রবণতাকে বলা হয় 'গুগল ইফেক্ট'। গুগল ইফেক্ট ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ার আরেক নাম।

গবেষণা বলে, প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ অনলাইন থেকে তথ্য পাওয়ার পর খুব অল্প সময়েই তা ভুলে যায়।

কী ক্ষতি হচ্ছে? 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ নিজের মনকে যত কম ব্যবহার করে, ততই তার মস্তিষ্কের জটিল সিস্টেমগুলোর ব্যবহার কম হয়। অন্যদিকে, কঠিন কাজ করলে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে, কগনিটিভ প্রক্রিয়া চালু থাকে। এতে বাড়ে ব্রেনের গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব। আর গ্রে ম্যাটার হলো ব্রেনের সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা। কঠিন কাজ প্রযুক্তির ওপর চাপিয়ে দিলে এই গ্রে ম্যাটারের ব্যবহার সেভাবে হয় না, ফলে ধীরে ধীরে এর ঘনত্ব কমে যেতে পারে।

আসলে আমরা স্মার্টফোনের কল্যাণে নানান সুবিধা পাচ্ছি বটে, কিন্তু তার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ককে। কারণ ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া এমন এক রোগ, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পেতে থাকে। সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এই রোগ। 

সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিরা ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। হঠাৎ করেই তারা অনেক কিছুই মনে করতে পারে না এবং তাদের আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। শঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে বর্তমানে বয়স্কদের পাশাপাশি তরুণরাও একই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা ফোন/ট্যাব ইত্যাদি স্মার্ট প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স, অর্থাৎ যে অংশ স্মৃতি জমা রাখার কাজ করে, সেটিকে পাতলা করে দেয়।বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই অংশ পাতলা হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ছোটবেলায় থেকেই তা হতে থাকলে অল্প বয়সেই পারকিনসন, আলঝেইমার, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে বাঁচতে করণীয়  

বলতে পারেন ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব! এর জন্যে স্মার্ট ফোন/ডিভাইস একেবারে বাদ দিতে হবে না, শুধু ব্যবহারটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। 

বিজ্ঞান লেখক ক্যাথেরিন প্রাইস বলেন, ‘ফোন ব্যবহার কমালে আসলেই মস্তিষ্কে কোনো প্রভাব পড়ে কিনা তার জন্যে যে কেউ নিজের ওপর পরীক্ষা চালাতে পারেন। কিছুদিন ফোনটাকে নিজের কাছ থেকে একটু দূরে রাখুন, ব্যবহার করা কমিয়ে দিন। লক্ষ্য করুন আপনি আগের চেয়ে শান্ত অনুভব করছেন কিনা, এবং আপনার মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ছে কিনা। পার্থক্যটা নিজেই বুঝতে পারবেন'। 

ডিভাইসের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে দিনের একটা অংশ, বিশেষ করে রাত ১১টা থেকে ভোর পর্যন্ত ডিজিটাল ফাস্টিং করুন। চমৎকার ঘুম হবে, বাড়বে সতেজতার অনুভূতি।

সেই সাথে জরুরি টুকিটাকি তথ্য মনে রাখার সচেতন প্রয়াস করুন। যত মস্তিষ্কটাকে কাজে লাগাবেন তত এটি থাকবে কর্মক্ষম, তুখোড় স্মৃতিধর।