published : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫
একুশ শতক যে তথ্যপ্রযুক্তির যুগ তা বলাই বাহুল্য। এখন তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে ডুবে আছি আমরা। একে দিয়ে ভালো-খারাপ দুইই করা সম্ভব। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচানো যায়; আবার সাইবার বুলিংএর মাধ্যমে একজন মানুষের জীবনকে ধ্বংসের দিকেও নিয়ে যাওয়া যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অবিরাম পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর যার জীবনে তথ্যপ্রযুক্তির কোনো প্রভাব নেই।
এখন থেকে তিন দশক আগেও মানুষ কবুতরের (ম্যাসেঞ্জার পিজিওন) মাধ্যমে তার প্রাকৃতিক জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে দূরবর্তী ও দুর্গম জায়গায় বার্তা পৌঁছাত। আর এখন স্মার্টফোনে এক ফিঙ্গার টিপেই বার্তা পৌছে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। ই-মেইল, এসএমএস ও অনলাইন মেসেজিংএর মাধ্যমে মনের কথা পৌঁছে যায় মুহূর্তেই শতসহস্র মাইল দূরে।
প্রযুক্তি জীবনের এতটাই কাছাকাছি এসেছে যে, কখন ওষুধ খাবেন, প্রতিদিন কতক্ষণ হাঁটবেন, কখন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে, কোন খাবার কতটুকু খাবেন অথবা বাসায় বসেই ইয়োগা কীভাবে করবেন তা মোবাইল অ্যাপ থেকে জানতে পারবেন খুব সহজেই।
প্রশ্ন হলো আধুনিক সময়ে তথ্যপ্রযুক্তিকে কি আমরা পুরোপুরি নিজের ও অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারছি? কারো কারো ক্ষেত্রে উত্তরটা হবে 'না'।
দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য আপনি ইন্টারনেটে পাবেন। কিন্তু ইন্টারনেটের ব্যবহার আমরা শুধু প্রয়োজনের মধ্যে সীমিত রাখি নি। রাখলে ফেসবুক ইউটিউব টুইটার ইনস্টাগ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকতাম না; ডুবে থেকে সময় নষ্ট, কাজে ব্যাঘাত, স্বাস্থ্যহানিও ঘটাতাম না।
আসলে যুগের প্রয়োজন মেটাতে প্রযুক্তি-দক্ষ হতে হবে ঠিকই, কিন্তু প্রযুক্তি-দাস হওয়া যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে আমরা এর শুধু কল্যাণটাই যেন নেই।
ধরুন, যোগাযোগের জন্যে ফোন জরুরি। কিন্তু এই ফোন কানে লাগিয়ে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন তাহলে এর রেডিয়েশনে বারোটা বাজবে আপনার কানের। কথা বলায় ফোনের পরিমিত ব্যবহার, হেডফোনে কথা বলা, ফোন চার্জে বসিয়ে কথা না বলা, ঘুমানোর সময় ফোন দূরে রাখা- এগুলোই হলো ফোনের কল্যাণকর ব্যবহার।
আবার লেখাপড়া বা পেশাগত প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ঠিক আছে; কিন্তু যদি সেটা নিছক বিনোদনের জন্যে ব্যবহার করেন, বাস্তব যোগাযোগের বদলে ভার্চুয়াল যোগাযোগে মত্ত থাকেন, অনলাইনে কাউকে উত্যক্ত বা সাইবার বুলিং করেন, কারো গোপনীয়তা নষ্ট করেন তাহলে তা নিজের বা অন্যের- কারো জন্যেই কল্যাণকর থাকে না।
মোটকথা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সীমারেখা বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
২০২০-২১ করোনাকালে যখন নিরাপত্তাজনিত কারণে রোগীদের জরুরি সেবাও ডাক্তাররা দিতে পারছিলেন না তখন অনেক রোগী উপকৃত হয়েছেন টেলিমেডিসিনের কারণে। এখনো যখন দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে রোগীর পক্ষে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয় না তখন বেশ কাজে দেয় এই টেলিমেডিসিন।
একই ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির অপরিণামদর্শী ব্যবহারের ফলে আপনি ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারেন। আপনার হয়ত কোনো শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, লক্ষণ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলেন। অনেক ধরণের সাজেশন আপনার সামনে আসবে, যার সবটাই সঠিক না। আবার কারো কারো জন্যে সঠিক হলেও সাধারণভাবে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। এই টিপস প্রয়োগ করে সুস্থ হওয়ার বদলে আপনি হতে পারেন আরো বেশি অসুস্থ। অতএব, ‘ডক্টর গুগল’এর ওপর নির্ভরশীল হবেন না।
অনেক দিন যোগাযোগ নেই এমন আত্মীয় বা বন্ধুকে আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে পেয়ে ভাবছেন সামাজিকতা রক্ষা হচ্ছে। অথচ সে কেমন আছে সে ব্যাপারে বাস্তবিক খোঁজই রাখলেন না। উল্টো তাদের চাকচিক্যময় পোস্টগুলো দেখে হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করলেন- না হলো তার উপকার, না নিজের।
সুস্থ বিনোদন আপনার মেধা-মননের বিকাশে সহায়ক হবে। বিপরীতে অশ্লীলতা গালিগালাজ গীবত পরকীয়ায় পূর্ণ সিরিয়াল সিরিজ সিনেমা, অপসংস্কৃতি, পর্ন যে আপনার ক্ষতি করবে তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
একটা সময় উচ্চশিক্ষার অনেক বই আমাদের হাতের নাগালে থাকত না। বিদেশী লেখকের বই ছিল অনেক দামী, সেই সাথে অপ্রতুলও। কিন্তু এখন আপনি ইন্টারনেটে এসব বইয়ের পিডিএফ পাচ্ছেন অনায়াসে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে।
এখন ক্লাসরুম এডুকেশনের বাইরেও কোরসেরা, খান একাডেমি, এবং উডেমির মতো অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করছে। জুম, গুগল মিট, এবং মাইক্রোসফট টিমসের মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো দূরশিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
রোগীরা এখন ঘরে বসেই অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পরামর্শ নিতে পারছেন টেলিমেডিসিনের বদৌলতে। এমনকি ডাক্তাররা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের সময় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান চিকিৎসকের পরামর্শও গ্রহণ করতে পারছেন।
দেশবিদেশের ই-কমার্স ও এম-কমার্সের মাধ্যমে ঘরে বসেই পণ্য কেনাবেচা করা যাচ্ছে। আবার ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে নিরাপদে ও দ্রুত করা যাচ্ছে অর্থ পরিশোধ ও লেনদেন।
উবার, পাঠাও ইত্যাদি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পরিবহনকে সহজ করেছে। জিপিএস ও গুগল ম্যাপ যান চলাচলকে করেছে সহজ। বাস ট্রেন বিমানের টিকিট কাটতে আর বাইরে বেরোনোর প্রয়োজন নেই।
এখন আপনি ব্যাংকে না গিয়েও একাউন্ট ওপেন, ব্যালেন্স চেক, ফান্ড ট্রান্সফার, ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট ইত্যাদি ব্যাংকিং সার্ভিস নিতে পারছেন ঘরে বসেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন, আয়কর রিটার্ন দাখিল, পাসপোর্ট ও ভিসা আবেদন, জিডি এন্ট্রি ইত্যাদি আপনি অনলাইনেই করতে পারছেন।
১. মাইন্ড সেট করুন
জানেন তো, যে ফুল থেকে মৌমাছি মধু নেয়, সেটা থেকে ভোমরা নেয় বিষ? তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আপনাকে হতে হবে এই মৌমাছির মতো; অজস্র ভালো-মন্দ কনটেন্ট থেকে আপনি নেবেন শুধু ভালোটাই। এজন্যে আপনাকে মাইন্ড সেট করতে হবে। তাহলেই দেখবেন আপনার জন্যে উপকারী ই-বুক, অনলাইন জার্নাল, ওয়েবসাইট, নিউজ, আর্টিকেল সব অনায়াসে পেয়ে যাচ্ছে। সাইটগুলোর অ্যালগরিদমই এমন যে ভালো জিনিস খুঁজলে ভালো জিনিসের সাজেশনই আপনি পেতে থাকবেন।
২. প্রযুক্তি ব্যবহারে শুদ্ধাচার মেনে চলুন
স্মার্টফোন জরুরি না হলে ফিচার ফোন ব্যবহার করুন। সময় জানার জন্যে মোবাইল ফোনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে হাতঘড়ি ব্যবহার করুন। ছোটখাট প্রয়োজন যেমন- শব্দের অর্থ ও বানান দেখা, হিসাব করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর হবেন না, এটা আপনার স্মৃতিশক্তি ও সহজাত দক্ষতা হ্রাস করে। ই-বুকের পরিবর্তে কাগজে ছাপা বই পড়ুন। প্রয়োজনে প্রিন্ট করে নিন।
অনির্দিষ্ট ও অফুরন্ত সময় নিয়ে টিভির সামনে বসবেন না। কোন অনুষ্ঠান কতক্ষণ দেখবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। প্রামাণ্য, শিক্ষামূলক, ভ্রমণ-বিষয়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক অনুষ্ঠানগুলোই দেখার জন্যে নির্বাচন করুন।
ক্ষতিকর কৌতূহল বর্জন করুন। কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন/ভিডিও/ওয়েবসাইটে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন।
স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার না করে ডেস্কটপ/ল্যাপটপে ব্যবহার করুন এবং দরজা খোলা রাখুন। মাসিক বাজেট ঠিক করুন। ই-মেইল, মেসেজিং, চ্যাটিং, শেয়ারিং, ব্রাউজিং, গেমিং, ইউটিউবে ভিডিও দেখা−এসবে কতটা সময় অপচয় হয়েছে, দিনশেষে হিসাব করুন। এতে ইন্টারনেটের অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ব্যবহার কমে যাবে।
অনলাইনে কোনো তথ্য/ছবি/ভিডিও দেখলেই তাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ না করে প্রয়োজনে এর উৎস এবং সত্যতা নিজেই যাচাই করুন। কোনো তথ্যের জন্যে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে খোঁজ করার পরিবর্তে নির্ভরযোগ্য ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটকে বেছে নিন।
অনলাইনে আপনার সব কর্মকাণ্ডের ডিজিটাল রেকর্ড থেকে যায়। তাই কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে সতর্ক থাকুন।
৩. ডিজিটাল ফাস্টিং করুন
খুব প্রয়োজন না হলে রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কোনো গ্যাজেট ব্যবহার করবেন না। এছাড়াও, মাঝেমধ্যে ৩/৪ ঘণ্টার জন্যে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বিরতি নিন।
৪. ব্যবহারের সময় বেঁধে দিন
যিনি শুধু প্রয়োজনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেন তিনি কিন্তু সারাদিন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেটে পড়ে থাকে না। প্রয়োজন শেষে উঠে পড়েন।
এমনকি যারা তথ্যপ্রযুক্তির উপকরণগুলো বানিয়েছেন, খোঁজ নিলে দেখবেন তারা নিজেদের জন্যে এসব ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কারণ তারা জানেন এগুলোর অপরিমিত ব্যবহার নিজের জন্যে কল্যাণকর না। যারা এসবের কারিগর তারাই যখন অতিব্যবহারের বিপক্ষে তখন আমি আপনিই বা তথ্যপ্রযুক্তির অতি ব্যবহার থেকে কী কল্যাণ পাব!