published : ৭ আগস্ট ২০২৫
একদিন নাসিরুদ্দিন হোজা বাজারে গিয়ে দেখেন সবাই খুব ব্যস্ত। একজন এসে বলল, "হোজা সাহেব! শুনেছেন, আজ নাকি বাজারে বিনামূল্যে ঘি বিতরণ করা হবে!”
হোজা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন, "ওহো! তাহলে তো আমি দেরি করে ফেলেছি’’- বলেই তিনি দৌড়ে বাড়ি গেলেন। ফিরলেন বড় এক মটকা হাতে। এত্ত বড় মটকা দেখে লোকজন জিজ্ঞেস করলো,
“হোজা! এত বড় মটকা কেন?”
হোজা জবাব দিলেন, "বিনামূল্যে যেহেতু ঘি দেয়া হচ্ছে, তাই পুরো পরিবারের জন্যেই নিতে এলাম!"
ভিড়ের মধ্য থেকে এক জ্ঞানী ব্যক্তি বললেন, “কিন্তু কে আপনাকে এমন কথা বললো?”
হোজা আঙুল উঁচিয়ে দেখালেন, "ঐ যে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা!"
জ্ঞানী ব্যক্তি গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই লোকটা ইতস্তত করে বলল, "ইয়ে মানে, আমি তো শুধু অনুমান করেছিলাম! বাজারে লোকজন হাঁড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে তো তাই আরকি!"
এরপর দেখা গেল, আসলে কেউ-ই জানে না এই খবরটা কোত্থেকে শুরু হয়েছে। অথচ পুরো বাজার এখন এই গুজবে সরগরম!
সব দেখেশুনে হোজা বললেন, এখন থেকে কেউ কোনো খবর দিলে বিশ্বাস করার আগে তাকে তিনটি প্রশ্ন করব- তুমি কি নিজে দেখেছ? কে তোমাকে বলল? তুমি কি নিশ্চিত?
তথ্যবিপ্লবের এই যুগে নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়া আপডেট, বিজ্ঞাপন, ভিডিও কন্টেন্ট সবকিছু যেন প্রতিদিন আমাদের ব্রেনের ওপর জেঁকে বসেছে। তথ্যের বিস্তৃতি এতটাই হয়েছে যে, এখন এটা "ইনফরমেশন পলিউশন" বা তথ্যদূষণের সৃষ্টি করছে। মিথ্যা খবর, সেনসেশনালিজম, ক্লিকবেইট আর অপ্রয়োজনীয় কন্টেন্ট আমাদের টোটাল ফিটনেসের ওপর ফেলছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। প্রতিনিয়ত আমরা একেকজন যেন হয়ে উঠছি হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে দৌড়ানো নাসিরুদ্দিন হোজা!
এ-বিষয়ে নবীজীর (স) শিক্ষা হলো-
শোনা কথা (সত্যতা যাচাই না করে) বলে বেড়ানোই মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্যে যথেষ্ট।—ওমর ইবনে খাত্তাব (রা), আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম
তাই সত্যতা যাচাই না করে শোনা কথা কখনো শেয়ার করবেন না।
রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজমের (RISJ) একটি গবেষণা প্রতিবেদন হচ্ছে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী ৪২% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা খবর শেয়ার করেছেন।
৫৮% মানুষ মনে করেন,গত পাঁচ বছরে ফেক নিউজের পরিমাণ বেড়েছে- ২০২৩ সালে এডলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটারের গবেষণার ফলাফল এটা।
আর ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ৩৫% মিলেনিয়াল এবং জেন-জি ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়া ডিটক্স নেয়ার কথা বিবেচনা করেছেন।
আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, অতিরিক্ত তথ্য গ্রহণের ফলে ৪৭% প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান উদ্বেগ, স্ট্রেস বা মনোযোগের সমস্যায় ভুগছেন।
Nature Human Behaviour-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনমতে, যারা নিয়মিত নেগেটিভ নিউজ কনজিউম করেন, তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার আশঙ্কা ১৭% বেশি।
আর হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ থেকে জানা যায়, ৭২% মানুষ এখন অতিরিক্ত তথ্য গ্রহণের ফলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
ইনফরমেশন পলিউশনের মতো মহামারিকে সচেতনতা ও সঠিক কৌশল প্রয়োগ করেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আপনার জন্যে এমন কিছু কৌশলঃ
১. ইনফরমেশন ডায়েট করুন
ইনফরমেশন ডায়েট হলো তথ্য গ্রহণ ও বর্জনের মান নিয়ন্ত্রণে সহজ সচেতন প্রক্রিয়া। কোনো ফুড ডায়েট রুটিনে যেমন কী খাবেন তা সুনির্দিষ্ট থাকে, তেমনি ইনফরমেশন ডায়েটেও আপনি পরিকল্পনা করেন কোন তথ্য নেবেন, আর কোনটা নেবেন না।
২০২২ সালে জার্নাল অব সোশ্যাল সাইকোলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিটের বেশি নিউজ বা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কমিয়েছেন, তাদের স্ট্রেস লেভেল ৩৪% কমেছে।
কীভাবে এই চর্চা করবেন?
ক. শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে তথ্য নিন।
খ. প্রতিদিন নিউজ/সোশ্যাল মিডিয়া চেক করুন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ে।
গ. অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।
ঘ. প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ রাখুন।
ঙ. অপ্রয়োজনীয় নিউজলেটার আনসাবস্ক্রাইব করে ফেলুন।
২. মিস-ইনফরমেশন ও ডিস-ইনফরমেশন চিনুন ও এড়িয়ে চলুন
মিস-ইনফরমেশন হলো অজান্তে বা ভুলবশত ছড়ানো ভুল তথ্য। আর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হলো ডিস-ইনফরমেশন।
বর্তমানে ডিস-ইনফরমেশন ছড়িয়ে দেবার হিড়িক দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে। সুপরিকল্পিত কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বা অর্ধসত্য তথ্য সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটি শুধুই ইনফরমেশন পলিউশন নয়, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র যা আপনাকে মনোজাগতিক দাসত্বে বন্দি করে রাখছে।
এমআইটি স্টাডি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ৭২% ফেক নিউজ ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এই ভাইরাল মহামারি থেকে মুক্তি পেতে ভুল তথ্য চিনুন। এজন্যে করণীয় হলো, নিউজ হেডলাইনের অতিরঞ্জিত এবং বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে যাওয়া, ক্রস-ভেরিফিকেশন (মানে একই নিউজ আরো ২-৩টি সোর্সে দেখা), ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট (যেমন Snopes, FactCheck.org) ব্যবহার, ‘শকিং!’ ‘অবিশ্বাস্য!’ এমন শিরোনামের সংবাদ এড়িয়ে চলা।
৩. ডিজিটাল ডায়েটিং ও ডিজিটাল ফাস্টিং করুন
ভার্চুয়াল দানবদের হাত থেকে মনোযোগ হাইজ্যাক হওয়া ঠেকাতে হলে আপনাকে ডিজিটাল ডায়েট ও ডিজিটাল ফাস্টিং করতে হবে। এজন্যে রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ফোন বন্ধ রাখুন। ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করুন। ঘুম থেকে ওঠার অন্তত এক ঘণ্টা পর ফোন হাতে নিন। কাজের সময় কমসে কম চারঘণ্টা ফোন অফ রাখুন।
কোনো সাইট, নিউজ, বিজ্ঞাপন, পডকাস্ট ও ভিডিওতে প্রতিটি ক্লিক করার আগে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- এটা কি আমার জন্যে প্রয়োজনীয়?
৪. মাইন্ডফুল কন্টেন্ট দেখুন/শুনুন
আপনি যা দেখেন বা শোনেন, তা-ই আপনার ভাবনাকে গঠন করে। আর মাইন্ডফুলনেস হলো ভাবনার গেটকিপার।
২০২২ সালে হার্ভাড বিজনেস রিভিউ প্রকাশিত তথ্যানুসারে, যারা মাইন্ডফুল তথ্য গ্রহণ করেন, তারা ৫০% বেশি সন্তুষ্ট এবং তাদের জ্ঞান লালন ও ধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রযুক্তি-দানবরা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আপনার যে মনোযোগ লুটে নিয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার উপায় হলো সচেতনভাবে মাইন্ডফুল কনটেন্ট দেখা/শোনা। এজন্যে ক্ষতিকর অ্যাপসের পরিবর্তে স্মার্টফোনে রাখুন কোয়ান্টামের আল কোরআনের মর্মবাণী, হাদীস শরীফ মর্মবাণী, শুদ্ধাচার এবং মেডিটেশনের মতো প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর অ্যাপস।
আসলে ইনফরমেশন ডায়েট শুধু ট্রেন্ড নয়; বরং এটি টোটাল ফিটনেসের জন্যে অপরিহার্য। তথ্যের সঠিক ফিল্টারিং ও পরিমিত ব্যবহার আমাদের মনোযোগকে বাড়াবে, লক্ষ্যে অটুট রাখবে এবং জীবনযাপনের মান উন্নত করবে।
তাই অতিরিক্ত তথ্য নয়; প্রয়োজনীয় তথ্য গ্রহণ করন, টোটালি ফিট থাকুন।