মোবাইল বোমা ॥ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শঙ্কায় আগামী প্রজন্ম

‘দূষণ’ শব্দটি আজ আমাদের খুব পরিচিত। কারণ বিভিন্ন প্রকার দূষণ আমাদের পরিবেশকে দিন দিন বিষাক্ত করে তুলছে। যেমন বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, আলোক দূষণ, ইত্যাদি। আরেকটি দূষণের কথা আজ বলবো যার নাম অনেকেই হয়তো শোনেন নি। এটা গন্ধহীন বর্ণহীন শব্দহীন ও অদৃশ্য কিন্তু মানবদেহ ও জীবজগতের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি অন্যান্য সব দূষণের চেয়ে অধিক ভয়ংকর। এই দূষণের নাম তড়িৎ দূষণ (Electropollution)।

এই দূষণের সাথে যুক্ত রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির তড়িৎ কৌশলসমূহ যেমন মাইক্রোওয়েভ ওভেন, হেয়ার ড্রায়ার, টোস্টার ইত্যাদি এবং কোটি কোটি ডলারের তারহীন যোগাযোগশিল্প অর্থাৎ মোবাইল ফোন প্রযুক্তি। তারহীন মোবাইল প্রযুক্তির মহাবিস্ফোরণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে উপহার দিচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ। ফলে দুই দশক আগের তুলনায় মানবসমাজ আজ কোটি গুণ বেশি তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ দূষণে আক্রান্ত। তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ দ্বারা ক্ষতির ব্যাপকতা এতই বিশাল যে, মোবাইল শিল্প দ্বারা সৃষ্ট তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ও তড়িৎ দূষণ আজ সমার্থক হয়ে পড়ছে।

ব্যাপক হারে মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং বাড়ি হাসপাতাল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে নির্মিত স্বল্প ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার এন্টেনা থেকে নির্গত তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি তড়িৎ দূষণের কারণ।

প্রথমে আসি মোবাইল ফোন সেটের কথায়। আমরা যখন মোবাইল ফোনে আলাপ করি, মোবাইল সেট তখন দুটি কাজ করে। এন্টেনা থেকে প্রাপ্ত তথ্যসংবলিত বিকিরণ শোষণ করে এবং ব্যবহারকারীর কথা উচ্চক্ষমতার বিকিরণের মাধ্যমে প্রেরণ করে। এই প্রক্রিয়ার সময় ব্যবহারকারীর দেহের টিস্যুসমূহ তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ফলে কোষ থেকে কোষে স্বাভাবিক যোগাযোগ পথ বিঘ্নিত হয়। বিশেষভাবে কান ও ব্রেনের কোমল টিস্যু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা ব্রেন টিউমার, অটিজম ইত্যাদি মারাত্মক ব্যাধির কারণ হতে পারে।

২০০৩ সালে অধ্যাপক কেইল মিলড (ওরেব্রো ইউনিভার্সিটি অব সুইডেন) এক গবেষণায় দেখান, দিনে গড়ে একঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে ব্রেন ক্যান্সার বা টিউমার হওয়ার ঝুঁকি ৩০% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে কোনো শিশু মাত্র দুই মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বললে স্বাভাবিক ব্রেন তরঙ্গ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়, যা পরবর্তী একঘণ্টায়ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আগে যেমন ১৯৭০ সালে ১০,০০০ শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া যেত একজন। ২০০৩ সালে এর হার হয়েছে ১৬৬ জন শিশুর মধ্যে একজন। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানী ও ডাক্তার এমনই ইঙ্গিত পাচ্ছেন। তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণের আঘাতে শিশুদের দেহকোষ ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ফলে জিনগত ক্ষতি হচ্ছে, যা অটিজমের চেয়েও মারাত্মক। গবেষণালব্ধ এ ফলাফলগুলো জানার পর তড়িৎ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের নিশ্চয়ই আর কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

তড়িৎ দূষণের আরো মারাত্মক দিক হলো স্বল্প ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার এন্টেনা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্গত বিকিরণ। মোবাইল ফোন আমরা সারাক্ষণ ব্যবহার করি না। কম ব্যবহারে বিকিরণ কম আঘাত করবে। কিন্তু কোনো বেইজ স্টেশন বা টাওয়ার এন্টেনা দিনে ২৪ ঘণ্টাই তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ চারদিকে ছড়াতে থাকে। কাজেই যারা এই টাওয়ারের নিচে বা আশপাশে বসবাস করেন তাদের সবাই অর্থাৎ আবালবৃদ্ধবনিতা নিজেদের অজান্তেই দিনের অধিকাংশ সময় উচ্চক্ষমতার বিকিরণে আঘাতপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এভাবে দীর্ঘসময় অবস্থান করায় আন্তঃকোষীয় যোগাযোগ সংকেত বিকৃত হতে পারে, যার ফলে শরীরের স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। সেইসাথে ক্যান্সার, ব্রেন টিউমার, অটিজম এবং লিউকেমিয়া ইত্যাদি জীবননাশী মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় বহুলাংশে।

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেশের অর্থনীতি অনুযায়ী যা হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে টাওয়ার এন্টেনা বসানোর সংখ্যাও অধিক। দুঃখের বিষয়, শিক্ষিত/ অশিক্ষিত এমনকি সরকারের উচ্চমহল পর্যন্ত তড়িৎ দূষণের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন। এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আর এ সুযোগে মোবাইল কোম্পানিসমূহ বাড়ি স্কুল কলেজ হাসপাতাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে এবং যেখানে সেখানে নির্বিচারে বেইজ টাওয়ার ও এন্টেনা স্থাপন করে চলছে। ঢাকা শহরে অনেক স্কুলের ছাদে পর্যন্ত এ দৃশ্য দেখা যায়।

প্রতিটি এন্টেনা থেকে উচ্চ ক্ষমতার বিকিরণ প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়াচ্ছে। আর প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় শিশুরা স্কুলে অতিবাহিত করছে। ফলে এরা শারীরিক দিক থেকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদি এই শিশুরা আজ থেকে ২০ বছর পর এই বিকিরণের আঘাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে-কেউ লিউকেমিয়া, কেউ ব্রেন ক্যান্সার, কেউ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে বা অন্যান্য মারাত্মক রোগে ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ হারায় তখন ভবিষ্যৎ নাগরিকদের এই পরিণতির জন্যে কে দায়ী হবে? সামান্য কিছু অর্থের লোভে আমরা আমাদের সন্তানদের কী সর্বনাশ করছি, একবার কি তা ভেবে দেখেছি?

অথচ উন্নত দেশে লোকালয়ের মধ্যে বিশেষ করে বাড়ি হাসপাতাল স্কুল কলেজ ও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে উচ্চক্ষমতার বেইজ স্টেশন স্থাপন করা হয়। তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র কোন মাত্রা পর্যন্ত নিরাপদ, এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে মাত্রা ঠিক করে দিয়েছে। ফরাসি বিশেষজ্ঞদের মতে, লোকালয় থেকে ১০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনো মোবাইল এন্টেনা স্থাপন করা যাবে না।

এখন আসি কী করে তড়িৎ দূষণ লাঘব করা যায় সেই প্রসঙ্গে। প্রথমত, মোবাইল ফোন কম ব্যবহার করুন। শুধু প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলে ফোন রেখে দিন। ‘অন’ অবস্থায় মোবাইল সেট দেহ থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট থাকুন। ঘুমের সময় সেটটি মাথার কাছে না রেখে পাঁচ-ছয় ফুট দূরে রাখুন। সেটের সাথে এয়ার পিস ব্যবহার করলে ঝুঁকির মাত্রা অনেকাংশে কমে।

শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে। টাওয়ার এন্টেনা লোকালয় স্কুল কলেজ হাসপাতাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে স্থাপন করতে হবে। নিজের এলাকায় তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের তীব্রতার মাত্রা নিরাপদ সীমার ভেতর রয়েছে কি না মনিটর করতে আপনি উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন। এছাড়াও মোবাইল সেট বাজারজাত করার আগে সেটির বিকিরণ মাত্রা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি।

পরিশেষে বলা যায়, যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করবো বটে, কিন্তু তা কোটি জীবনের বিনিময়ে নয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। আর এজন্যে সাধারণ জনগণকে আরো সচেতন করে তুলতে হবে।

লেখক : ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা

         অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ

         ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

         সৌজন্যে : সাপ্তাহিক বিপরীত স্রোত (ডিসেম্বর ২০১১)