ইলেকট্রনিক ডিভাইসের রেডিয়েশন থেকে নিরাপদ থাকুন; কিছু টিপস

আধুনিক বিজ্ঞান জীবনকে সহজ করতে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে হরেক রকম বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। খাবার রান্না করতে ইন্ডাকশন কুকার, রান্না করা খাবার ভালো রাখতে ফ্রিজ, ফ্রিজে থাকা ঠান্ডা খাবার গরম করতে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যবহার চলছে হরদম। আর স্মার্টফোন, টিভি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ওয়াইফাই তো এখন জীবনেরই অঙ্গ!

কিন্তু নিত্যদিনের সঙ্গী এই ডিভাইসগুলো থেকে বিচ্ছুরিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন যে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করছে তা কি আপনি জানেন?

রাউটার, মডেম, ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক  

এগুলো থেকে নির্গত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনই শরীরের ক্ষতি করে বেশি- বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

আমরা সাধারণত যে তরঙ্গের সাহায্যে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করে থাকি, সেই একই তরঙ্গ বিকিরিত হয় ওয়্যারলেস রাউটারে। অন্যদিকে, ওয়াইফাই সিগন্যাল ত্বক ভেদ করে চলে যায় শরীরের অভ্যন্তরে। 

তাছাড়া, কেউ যখন ওয়াইফাই সিগন্যাল সার্চ করে তখন তরঙ্গ চলাচল করার সময় আশেপাশে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে, যা থেকে উৎপন্ন হয় রেডিয়েশন।

মোবাইল ফোন ও টেলিভিশনের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরন

মোবাইল ফোন তথ্য আদান-প্রদানে তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ ব্যবহার করে। ডব্লিউএইচও’র গবেষণা অনুযায়ী, একটি মোবাইল ফোন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সমপরিমাণ রেডিয়েশন ছড়িয়ে থাকে।

অন্যদিকে, টেলিভিশন তারের মধ্যে ইলেকট্রনিক সিগনাল ব্যবহার করে, যা পরবর্তীতে ইলেকট্রন বীমে রুপান্তরিত হয়। টিভি সেটের কাছাকাছি মোবাইল ফোন থাকলে কল এলে মোবাইলের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরন টেলিভিশনের ইলেকট্রন বীমের সাথে ওভারল্যাপ করে, ফলে টেলিভিশনের ইলেকট্রনিক সিগন্যালের পরিবর্তন ঘটে আশেপাশে রেডিয়েশনের বিস্তার ঘটে।    

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

অতিরিক্ত মোবাইল/স্মার্টফোন, কম্পিউটার/ল্যাপটপ, টেলিভিশন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি ব্যবহার করলে রেডিয়েশনের ফলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যার মধ্যে আছে মাথাব্যথা, অনিদ্রা, দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, শুক্রাণু মান ও সংখ্যা হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভপাত, ব্রেন টিউমার এমনকি ক্যান্সারও।

বিজ্ঞানীদের মতে, ১ থেকে ৫ বছর অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে ব্রেন টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা ১২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ৫ থেকে ১০ বছর ব্যবহার করলে বাড়ে ২৫০ শতাংশ; আর ১৫ বছর বা তার বেশি ব্যবহার করলে বাড়ে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত!

বিশ্বজুড়ে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ১৯৮০ সালে যা ছিল প্রতি ৫০০ জনে একজন, এখন সেটা প্রতি ৬৮ জনে একজন! এর জন্যে বিজ্ঞানীরা যে বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন তার মধ্যে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন অন্যতম।    

বিশ্বজুড়ে হৃদরোগ বেড়ে যাওয়ারও অন্যতম কারণ তড়িৎচুম্বকীয় দূষণ। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার পরও যে অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, এটি তার অন্যতম কারণ।

‘বেশী কথা মোবাইলে কান যাবে অকালে!’   

মোবাইল ফোনের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকটিকে এভাবেই বর্ণনা করেন দেশের প্রখ্যাত নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত। WHO-র সমীক্ষার রেফারেন্স দিয়ে তিনি বলেন, মোবাইল ফোনে একনাগাড়ে ২০ সেকেন্ডের বেশি কথা বললে কানের সমস্যা হতে পারে। মস্তিষ্ক পড়তে পারে ক্যানসারের ঝুঁকিতে।

মোবাইল ফোন দেখিয়ে বাচ্চাদের খাবার খাওয়ান এমন মা আছে প্রচুর। এটি নিষেধ করে ডা. দত্ত বলেন, শিশুরা যখন খাওয়ার সময় স্মার্টফোন বা ট্যাব দেখে তখন ডিভাইসগুলোর রেডিয়েশনে খাবারের পুষ্টি নষ্ট হয়।

অর্থাৎ, একদিকে ফোনের রেডিয়েশনের সরাসরি ক্ষতি, অন্যদিকে খাবারের পুষ্টি বিনষ্ট হয়ে পরোক্ষ ক্ষতি- দুটোই হয় একই সাথে।

তাই আসুন সচেতন হই

যত ক্ষতিকরই হোক না কেন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার আমরা ছাড়তে পারছি না- এটা একটি বাস্তবতা। তবে ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলেও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার তো কমাতে পারি! পাশাপাশি কিছু সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে অনেকাংশেই বাঁচতে পারি রেডিয়েশন থেকে।  

কিছু টিপস-   

  • ঘুমানোর আগে রাউটার, মডেম ও অন্যান্য ইন্টারনেট ডিভাইস বন্ধ করুন; মাথার পাশে স্মার্টফোন/মোবাইল রেখে ঘুমাবেন না;
  • ল্যান্ডফোনে কথা বলার সুযোগ থাকলে সেলফোন এড়িয়ে চলুন; সেলফোন/স্মার্টফোনে কথা বললে হেডফোন বা স্পিকার ব্যবহার করুন;    
  • স্মার্টফোনের বিভিন্ন সার্ভিস, যেমন−ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, জিপিএস, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি প্রয়োজন শেষে বন্ধ রাখুন;
  • কল করার সময় যখন ওপাশে রিং বাজতে থাকে তখন ডায়ালকারীর সেট থেকে অনেক বেশি রেডিয়েশন নির্গত হয়। তাই অপর পক্ষ কল রিসিভ করার পর ফোন কানের কাছে আনুন।
  • মোবাইল টাওয়ার থেকে যতটা সম্ভব দূরে বাসা নিন; নিজ বাসভবনে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করতে দেবেন না;   
  • বৈদ্যুতিক চুলা, ইন্ডাকশন কুকার, ইলেক্ট্রিক কেটলি ইত্যাদির ব্যবহার বাদ দিন বা কমান; খাবার রান্না বা গরম করুন ইলেকট্রনিক কুকওয়্যারের বদলে ভিন্ন কিছুতে (যেমন গ্যাসের চুলায়);  
  • অনলাইন ক্লাস/কোচিং বা অন্য জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শিশুদের হাতে ডিভাইস দেবেন না, খাওয়ার সময়ে তো নয়ই!