সুইজারল্যান্ডের জুরিখের একটি স্কুল। বছর চারেক আগে সে স্কুলের শিক্ষার্থীরা হঠাৎ কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করল। শিক্ষকরাও যেন কিছুটা বদমেজাজি ও খিটখিটে হয়ে উঠলেন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।
পরবর্তীতে জানা গেল, স্কুল-সংলগ্ন মোবাইল ফোনের অতিকায় টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশনই এর প্রধান কারণ, যা মানবমস্তিষ্কের সহ্যশক্তির অতীত। মোবাইল কোম্পানির নামে মামলা হলো। বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে টাওয়ার সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো তারা।
আমাদের দেশেও যত্রতত্র বসানো হচ্ছে মোবাইল টাওয়ার। জনসংখ্যা অনুপাতে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোবাইল ব্যবহারকারীর দেশ! গাড়ি চালাতে চালাতে বা রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলছে, এমন দৃশ্য আজকাল অহরহই দেখা যায়। সাথে মরণঘাতী সেলফির হুজুগ তো আছেই। প্রশ্ন হলো, মোবাইল ফোন ব্যবহার কি বিপদজনক? এটা আসলে বিপদজনকের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, একটি মোবাইল ফোন মাইক্রোওয়েভ ওভেনের সমপরিমাণ রেডিয়েশন ছড়িয়ে থাকে। ১৫ মিনিট একটানা মোবাইলে কথা বললে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বাড়তে থাকে। ফলে কান-সংলগ্ন ত্বক আগুনের মতো লাল হয়ে যায়। কান গরম হয়ে যায়, শুরু হয় মাথাব্যথা।
এখানেই শেষ নয়। এর সাথে আছে এন্টেনার রেডিয়েশন, যা মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি! আমরা জানি, ১০১ ডিগ্রিতেই শিশুদের খিঁচুনি হয়। তাহলে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা যখন ১০৩ ডিগ্রিতে ওঠে তখন তার টিস্যুগুলোর কী অবস্থা হচ্ছে! ভেবে দেখুন একবার। কী পরিমাণ খিঁচুনি ওখানে হচ্ছে।
ভারতের টেলিযোগাযোগ ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টার প্রণীত খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বেজ স্টেশনের এন্টেনা থেকে নির্গত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের প্রভাবে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হন অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুরা। বাচ্চা খেতে না চাইলে অনেক মা মোবাইলে কিছু একটা চালু করে দেন। বাচ্চা ওটা একঘণ্টা ধরে দেখতে থাকে আর মা তাকে খাইয়ে দেন। কিন্তু তিনি খেয়াল করেন না যে, সন্তান এই একঘণ্টা ধরে রেডিয়েশনও হজম করছে। অর্থাৎ পুষ্টি যতটুকু নিচ্ছে তার চেয়ে অপুষ্টি নিচ্ছে বেশি। তাই দীর্ঘ গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বয়স ১৬ হওয়ার আগে কোনো অবস্থাতেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অটিজম-আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বিশ্বজুড়েই বেড়ে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ১৯৮০ সালে যা ছিল প্রতি ৫০০ জনে একজন, এখন সেটা প্রতি ৬৮ জনে একজন! অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে সে-দেশের বিজ্ঞানীরা যে বিষয়গুলোকে দায়ী করছেন-তার মধ্যে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন অন্যতম।
মোবাইল ফোনে বহু সময় ধরে কথা বললে আপনি অবসন্ন হয়ে পড়বেন, মাথাব্যথা করবে। অনেকক্ষণ কথা বলে ঘুমাতে গেলেন, ঘুম আসবে না। আর বিরামহীনভাবে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তাদের স্মৃতিশক্তিতে ধস নামে এবং কাঁধ, কনুই ও কব্জির জয়েন্ট ক্রমশ অকেজো হয়ে যায়।
মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দেয়ার জন্যে এর চারপাশে ‘ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার’ নামে একটি আবরণ আছে। অল্প কিছু ছাড়া অধিকাংশ ওষুধই এই দেয়াল অতিক্রম করতে পারে না। এই দেয়ালের জন্যেই অনেক ওয়েভ ব্রেনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু অনেক সময় ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলার ফলে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং এর রক্তনালীগুলো সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। রক্তনালীর দেয়ালগুলো তখন উন্মুক্ত হয়ে যায়। আর মোবাইলের মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন সরাসরি এন্ডোথেলিয়াল সেলের প্রোটিন কাঠামোকে বদলে দেয়, সে সুযোগে টক্সিন মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করে।
আরেকটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, মোবাইলের রেডিয়েশন কি ব্রেন টিউমার সৃষ্টি করতে পারে? টক্সিনের প্রভাবে নার্ভ সেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিএনএ-র কর্মকাঠামো বদলে যায়। কোনো ডিএনএ যদি একবার অস্বাভাবিক হয়ে যায়, তাহলে সে সবসময় অস্বাভাবিক ডিএনএ-ই রেপ্লিকেট করবে। ফলে ব্রেন টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
ব্রেন ক্যান্সার সংক্রান্ত বিস্তর গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, একজন মানুষ যদি এক থেকে পাঁচ বছর অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাহলে তার ব্রেন টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ১২৫ শতাংশ। পাঁচ থেকে ১০ বছর ব্যবহার করলে সম্ভাবনা বাড়বে ২৫০ শতাংশ। আর যারা ১৫ বছর ধরে ব্যবহার করছেন তাদের সম্ভাবনা বাড়ে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত! সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ স্যালাইভা গ্ল্যান্ডের টিউমার বাংলাদেশে বহুগুণ বেড়ে গেছে। এর পেছনেও আছে মোবাইল ফোনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তাই বলা যায়, বেশি কথা মোবাইলে, কান যাবে অকালে!
এখন করণীয় কী? প্রথমত, মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময়সীমা কমিয়ে দিতে হবে। মোবাইলে কারো সাথে আলাপের আদর্শ সময় হলো ২০ সেকেন্ড। তিন মিনিটের বেশি তো কোনোভাবেই নয়। যদি কেউ তিন মিনিট কথা বলে ফেলেন, তাহলে পরবর্তী ১৫ মিনিটের মধ্যে তার আর ফোন ব্যবহার করা একেবারেই উচিত হবে না।
দ্বিতীয়ত, হেডসেট বা স্পিকার ব্যবহার করুন। অ্যানালগ বা ল্যান্ডফোন যদি হাতের নাগালে থাকে তাহলে সেলফোন ব্যবহার করবেন না। পারতপক্ষে মোবাইল ফোন শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন। আবার অনেকে আছেন যারা ঘুমানোর সময় ফোনটি বিছানায় এমনকি মাথার ঠিক কাছেই রাখেন, এটা কখনোই করা যাবে না।
তৃতীয়ত, যত্রতত্র মোবাইল ফোনের এন্টেনা বসানো যাবে না।
আসলে যে-কোনো ব্যাপারে ব্যক্তিগত সচেতনতাই সবচেয়ে জরুরি। এটা মেনে নিতেই হবে যে, মোবাইল ও কম্পিউটার আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। অনেক কাজ আগের চেয়ে বেশ সহজ হয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু এদের আবার কিছু অদৃশ্য বিপদও আছে। এই স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলোর ব্যাপারে পূর্বসতর্কতা নিলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব। আর আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্যেই সেটা জরুরি।