ব্যথা ও সে

published : ২৭ মার্চ ২০১৭

ছোটবেলায় পিটি প্যারেডে মেয়েটিকে কখনো সামনে রাখা হতো না। কারণ শপথের সময় সবাইকে যখন হাত তুলতে বলা হতো, সে সেটা পারতো না। জন্মগত কিছু ত্রুটির কারণে তার ডান হাতটা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট। আর একটু বড় হওয়ার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটে সেই হাতেরই কনুইটা যখন ঘুরে গেল একটু ভেতরের দিকে, বেঢপ সাইজের এই হাতটা তখন আর লুকিয়ে রাখার কোনো উপায় ছিল না!

কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যা ছিল ব্যথা। ব্যথা এত তীব্র ছিল যে, লিখতে, পড়তে এমনকি ঘুমোতে পর্যন্ত কষ্ট হতো তার। শপথ পাঠের সময় দীর্ঘক্ষণ হাত তুলে রাখতে এজন্যেই ছিল তার অপারগতা।

শারীরিক এই অক্ষমতার ব্যাপারে তার কিছু করার নেই জেনেও দিনের পর দিন প্যারেড চলার সময়টায় মেয়েটি লজ্জায় কুঁকড়ে থাকতো। দেখা যেত, সহপাঠীরা যখন দৃপ্তকণ্ঠে শপথ উচ্চারণ করছে, সে তখন জড়সড় হয়ে আছে সংকোচে! 

একবার অসহ্য ব্যথা শুরু হলো। বাবা তাড়াতাড়ি নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে। পরিচিত ডাক্তার সাহেবকে দেখে ছোট্ট মেয়েটি প্রথমবারের মতো জিজ্ঞেস করল, আংকেল, আমার এই ব্যথা কবে সারবে। ব্যস্ত ডাক্তারের ঝটপট জবাব, “কোনোদিনও না”। একবারও ভাবলেন না, কচি মনে এরকম একটা ভীষণ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া কত মারাত্মক হতে পারে!   

বিধ্বস্ত হৃদয়ে বাবার সাথে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মেয়েটি শুধু ভাবছিল, কেন এমন হলো তার জীবনে! নিজেকে আরো গুটিয়ে নিল। কোথাও গেলেই সবাই জানতে চাইত, হাতে কী হয়েছে? সমমর্মিতার চেয়ে কৌতূহল আর কৃত্রিম করুণাই যেন ঝরে পড়তো তাদের জিজ্ঞাসু কণ্ঠে। 

কখনো কখনো বিব্রতও হতে হতো! একবার এক রিক্সাওয়ালা ভাড়া নিতে চাইল না। কারণ বাঁ হাতে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে সে নাকি রিক্সাওয়ালাকে অপমান করেছে! আরেকবার দাম মেটাতে গিয়ে দোকানীর তুমুল বাক্যবাণ! কত বড় বেয়াদব! বাঁ হাতে টাকা দিচ্ছে! অথচ একটু খেয়াল করলেই তারা দেখতে পেত যে মেয়েটির ডানহাতটা স্বাভাবিক নয়। একটা কোনো অসুবিধা আছে বলেই শিষ্টাচারের লঙ্ঘন জেনেও তাকে এটা করতে হচ্ছে।

এদিকে বড় হবার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যথাও যেন ক্রমশ বাড়ছিল। ওষুধ খেয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ ব্যথাটা হয় হাত নাড়ালেই। আর দিনের অসংখ্য মুহূর্তে কতক্ষণ একজন মানুষ তার একটা অঙ্গ না নাড়িয়ে থাকতে পারে! আংটি-চুড়ি পরা, ব্যাগ কাঁধে নেয়া- সব বন্ধ হয়ে গেল।

একটা সময় মেয়েটি নিজেই একটা সমাধান খুঁজে বের করল! ব্যথা যেহেতু কমছে না, অতএব তাকে কমানোর চেষ্টা না করে ঠিক করল, এটাকে উপেক্ষা করবে। বাড়িয়ে দিল তার বাঁ হাতের ব্যবহার। ব্যথা যাতে জীবনের গতিকে থামিয়ে দিতে না পারে, সেজন্যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতে লাগল। বুঝে গেল অহেতুক কৌতূহলীদের প্রশ্নবাণের মোকাবেলা কীভাবে করতে হয়!    

কিন্তু একটা ভাবনা থেকেই যাচ্ছিল। ব্যথাটা কেন হয়? একজন বিশেষজ্ঞ বললেন, হাতের মাঝের বাটিটা নেই তাই হাড়ে হাড়ে ঘষা লাগছে। (তা তো বটেই। পরিণামটা তো সে প্রতি মুহূর্তেই টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে!)। তিনি বললেন, কৃত্রিমভাবে এই বাটি প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু চান্স ৫০:৫০। 

৫০:৫০ চান্স তো আসলে কোনো চান্স না। হাঁ যা, না-ও তা। অতএব সে চিন্তা বাদ।

এসময়েই ঘুরে গেল তার জীবনের মোড়। কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করার সুযোগ হলো তার। সুযোগ হলো হিলিং ও সাইকি কোর্স করার। নিরাময়ের জন্যে চেতনার শক্তি, মনের শক্তিকেও ব্যবহার করা যায়- এ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে যেন নতুন আশা জোগাল।

নিজেই নিজেকে বলল, ব্যথা কেন  থাকবে? আমি যদি চাই, তাহলে আমার ব্যথা কি করে থাকে! কোর্স থেকে বেরিয়েই বাইরে সেলস থেকে একটি ‘কোয়ান্টাম বালা’ কিনে কবজির মধ্য দিয়ে গলিয়ে দিল। মনে মনে আওড়াতে লাগল, “I challenge you pain”.

অদ্ভুত কাণ্ড! যে হাত বালা-চুড়ি পরে থাকা তো দূরের কথা, পরার সময়ই ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠতো, সেই হাত অবলীলায় বালা পরে ফেলল। এতগুলো বছর পরেও আছে বেশ! হরদম ব্যাগ কাঁধে তুলছে! রিক্সাভাড়াও সে এখন ডান হাতেই দেয়। ব্যথা যেন হারিয়ে গেল ভোজবাজির মতো!

একবার একজন বিশেষজ্ঞকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কী করে হলো এ নিরাময়!। তিনি বললেন, হতে পারে, আপনার অবচেতন মনের প্রোগ্রামিং এত পাওয়ারফুল হয়েছে যে, ঐ ঘষার জায়গাটায় আপনার দেহ হয়তো জেলিজাতীয় কিছু তৈরি করছে। ফলে ঘষা আর লাগছে না! ব্যথাও হচ্ছে না!    

মজার ব্যাপার হলো, ব্যথাটার উৎস আপাত খুব সুস্পষ্ট শারীরবৃত্তীয় কারণ হলেও এর সাথে মনের যোগের প্রমাণও মেয়েটি পেয়েছে অনেকবার। দেখেছে, যখন ওর মন খারাপ থাকে বা খুব স্ট্রেসড থাকে, তখন ব্যথাটাও যেন ফিরে আসে!

এ কি অলৌকিক?

নিরাময়ের এ ঘটনাটি আসলে নতুন কিছু নয়। মেডিটেশনের নিরাময়ক্ষমতার হাজার হাজার ঘটনারই একটি। আপাতদৃষ্টিতে অলৌকিক আর অবিশ্বাস্য মনে হলেও এক দারুণ বৈজ্ঞানিক কার্যকারণেই ঘটছে এসব।

ধরুন একটি ঘর। ঘরটা যদি বোঝাই থাকে নানান সব জঞ্জাল আর আবর্জনা দিয়ে, তাহলে যত সুগন্ধি আর ফ্রেশনারই ব্যবহার করা হোক না কেন, ঘরের দুর্গন্ধ কি যাবে? যাবে না।

মনের অবস্থাও তাই। রাগ-ক্ষোভ, নেতিবাচকতা, কষ্ট, হতাশা, দুশ্চিন্তা এসব দিয়ে যে মন আচ্ছন্ন থাকে, সে মনকে ধারণ করে আছে যে দেহ, তা কখনো সুস্থ থাকতে পারে না। আর এখানেই নিহিত আছে সুস্থতার গূঢ় রহস্য। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে নবীজি (স) এর একটি হাদিসের মর্মেই নিহিত ছিল যা। হাদিসের মর্মটি হচ্ছে, মনের দূষণ দেহকে অসুস্থ করে। মন দূষণমুক্ত হলে দেহও সুস্থ হয়ে যায়।

কীভাবে ঘটছে এ নিরাময়?

২৫ বছর আগে কোয়ান্টাম এ বিশ্বাস নিয়েই যাত্রা শুরু করল। মেডিটেশনের মতো কার্যকরী এক ‘মাইন্ড ক্লিনিং এবং ব্রেন কুলিং’ পদ্ধতি নিয়ে মানুষের সামনে এল। অর্থাৎ মনকে যা পরিষ্কার করবে, ব্রেনকে যা ঠাণ্ডা রাখবে। আর তার ফলও ফলতে শুরু করল সাথে সাথেই।

কোর্সে এসে একের পর এক মেডিটেশন করতে করতে আর সঠিক জীবনদৃষ্টির কথা শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই অংশগ্রহণকারীরা মাইন্ড ক্লিনিং আর ব্রেন কুলিংয়ের এই প্রক্রিয়ায় একাত্ম হয়ে যেতে লাগলেন। ফলে চারদিন শেষে তাদের অনেকেই অনুভব করলেন সুস্থতার এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। ব্যাকপেইন, মাইগ্রেন ও নানা ধরনের ব্যথা বেদনার মতো ক্রনিক (মানে ডাক্তার বলে দিয়েছে ‘ভালো হবে না’) এবং সাইকোসোমাটিক রোগগুলোর মূল কারণগুলো যখন দূর হয়ে গেল, সেরে গেল তাও।     

কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে এসে লাখো মানুষের সুস্থতার রহস্য এখানেই। আর হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল এখন এই কার্যকারণের প্রমাণই দিচ্ছে।