আনন্দময় কর্মব্যস্ততা বিষণ্নতা রোধ করে

published : ১৮ মে ২০১৬

বিষণ্নতাজনিত কারণে সম্প্রতি আত্মহত্যা করলেন অস্কারজয়ী জনপ্রিয় মার্কিন কৌতুকাভিনেতা রবিন উইলিয়ামস। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অবিশ্রান্ত চলছেই। এর পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিদ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের কপালে দেখা দিয়েছে নতুন চিন্তার রেখা। হন্যে হয়ে সবাই খুঁজে ফিরছেন ক্রম-আগ্রাসী বিষণ্নতার কারণ আর এটি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়।

টাইম ম্যাগাজিনের সদ্য প্রকশিত একটি সংখ্যায় বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন খ্যাতনামা মার্কিন টিভি ব্যক্তিত্ব ও ডিক ক্যাভেট্ শো-এর উপস্থাপক ডিক ক্যাভেট্। বক্সিং দি ব্ল্যাক ডগ নিবন্ধটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত শতাব্দীর ব্রিটিশ রাজনীতিক ও প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বিষণ্নতাকে অভিহিত করেছেন ব্ল্যাক ডগ বা কালো কুকুর হিসেবে।

মি. ক্যাভেট্ লিখেছেন, শিল্পী-অভিনেতা-টিভি পারফর্মারদের মধ্যে বিষণ্নতার আক্রমণ তুলনামূলক বেশি। যশ-খ্যাতি-পরিচিতি আর কাজের চাপ এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে কিছুটা একঘেঁয়েমির জন্ম দেয়। পাশাপাশি খ্যাতি সুরক্ষার স্নায়ুচাপ তো আছেই নিত্যসঙ্গী হয়ে। তখন এ থেকে মুক্তি পেতে আর জীবনে কিছুটা বৈচিত্র্য আনতে কেউ কেউ ঝুঁকে পড়েন এলকোহল ও নেশার দিকে। এতে ফল হয় উল্টো।

এলকোহল সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে করে তোলে আরো অবসন্ন ও ধীর। সবমিলিয়ে সৃষ্টি হয় একধরনের আবেগজনিত ভারসাম্যহীনতা, প্রায়শই যা মানুষকে আত্মঘাতপ্রবণ করে তোলে। সহসাই তখন সে ভুলে যায় জীবনসঙ্গী, সন্তান আর প্রিয়জনদের কথা। সবচেয়ে বেশি তুচ্ছ মনে হয় তার নিজের জীবনটাকেই। আত্মহত্যাই তখন তার কাছে হয়ে ওঠে একমাত্র সমাধান। আর অঘটনগুলো এভাবেই ঘটে।

সদ্য প্রয়াত রবিন উইলিয়ামসের সাথে বছর কয়েক আগে এক পার্টিতে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেছেন ডিক ক্যাভেট্। সেদিন ক্লাবভর্তি দর্শককে অনেকক্ষণ ধরে বিস্তর হাসিয়ে-মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষে ক্যাভেট্ তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলে পরে উইলিয়ামস একটু বিমর্ষ হেসে বলেছিলেন, ‘সবাইকে এতক্ষণ হাসি-আনন্দে মাতিয়ে রাখলাম, কেবল নিজেকে ছাড়া। অভিনেতাদের বাড়তি সুবিধাটা এখানেই- অন্যদের বিষণ্নতাটা ধরা পড়ে যায়, কিন্তু আমরা জানি ওটা কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয়। বিষয়টা খুব মজার, তাই না?’

নিজের জীবনেও একসময় এমন কঠিনতর সময় পার করে এসেছেন ক্যাভেট্। ভীষণ কষ্টের সেই সময়টিতে তিনি রীতিমতো হতবুদ্ধি আর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। এ অবস্থায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন বিংশ শতকের মহান অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো-কে। অসহায় ক্যাভেট্ তার কাছে সমস্যা খুলে বললে ব্রান্ডো পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিষণ্নতা যতই তীব্র হোক, তোমার কাজটা তুমি করে যাও, তাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করো, আনন্দ নিয়ে করো, ওতে ডুব দাও।’

ক্যাভেট্ বলছেন, আমি তা-ই করলাম। জোর করে চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে ভালো বোধ হতে লাগল। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হতে শুরু করল আমার। একাকিত্ব কেটে গেল। আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম।

এই নিজেকে খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরি। যতই দুঃসময় আসুক, আমরা যেন নিজেকে হারিয়ে না বসি। যেন ভুলে না যাই-আমি কে? এই আত্মোপলব্ধিটাই পারে মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে। পারে সচল রাখতে।

ডিক ক্যাভেট্ নাছোড়বান্দা। এমন আত্মঘাতী বিষণ্নতার চিরস্থায়ী বিনাশ চান তিনি। নিজের জীবনে এর কষ্টটা অনুভব করেছেন বলেই সবাইকে জানাতে চান এটি প্রতিকারের উপায়। তাই তিনি সম্প্রতি কথা বলেছেন একজন তুখোড় মেধাবী সাইকো-ফার্মাকোলোজিস্টের সাথে। কারণ তার ধারণা, ৩০-৪০ বছর আগের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় এখন নিশ্চয় এর একটা বিহিত আছে। কিন্তু তাকে শুনতে হলো-‘না, আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারি নি, উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখানে ঘটে নি। আমরা আতঙ্কিত।’

উল্লেখ্য, গত কয়েক দশকে পৃথিবীজুড়ে, বিশেষত পাশ্চাত্যে, বেড়ে চলেছে নির্মম স্নায়ুঘাতী বিষণ্নতার প্রকোপ। এ নিয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান তাই চলছেই। সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণার ফলাফলে বলা হচ্ছে-ওষুধ নয়, বরং ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি, মমতাময় পারিবারিক পরিবেশ, সুষম খাদ্যাভ্যাস, আনন্দময় কর্মব্যস্ততা, কাউন্সেলিং ও মেডিটেশন বিষণ্নতা প্রতিরোধ ও নিরাময় করে।

তথ্যসূত্র : টাইম ম্যাগাজিন (২৫ আগস্ট, ২০১৪)