published : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
পৃথিবীতে চার অক্ষরের যে শব্দটি সব থেকে বেশি উচ্চারিত হয় তা হলো- ‘Love’.
বাংলাতে আমরা যাকে বলি ‘ভালবাসা’, ‘প্রেম’।
ভালবাসা মানুষের মধ্যে এক ধরনের পুলক সৃষ্টি করে, সুখানুভূতির জন্ম দেয়। বিশেষ কারো সঙ্গ লাভের আকুলতা তৈরি করে; কাছাকাছি থাকতে ব্যাকুল করে তোলে।
প্রেম- একটি শক্তিশালী আবেগ, বলা যেতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী!
বিজ্ঞানীরা প্রচুর গবেষণা করেছেন এটা বোঝার জন্যে যে, প্রেম বা ভালবাসা আসলে কীভাবে কাজ করে? মানুষ কি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রেমে পড়ে হয় নাকি কোনো নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হয়?
প্রেম কি মস্তিষ্কজাত নাকি হৃদয়ঘটিত? কারো প্রতি ভালবাসা কি আজীবন স্থায়ী হতে পারে নাকি ক্ষণিকের?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ভালবাসার যে তীব্রতা, বৈচিত্র্যতা এবং ভালবাসাহীনতার প্রভাবের যে গভীরতা তা শুধুমাত্র মানুষের মধ্যেই। অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে ব্যাপারটা এভাবে দেখা যায় না।
মা-বাবার ভালবাসা শিশুর জন্যে খাবার এবং পানীয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ!
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী হ্যারি হার্লো ৫০ এর দশকে এ নিয়ে এক বিতর্কিত গবেষণা চালান। একটি বানরশিশুকে তার মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ল্যাবে ঢুকিয়ে দেন।
সেখানে ছিল দুটি মা মূর্তি। একটি থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে দুধ আসত। আরেকটি স্রেফ একটি ইমেজ বা ছবি।
দেখা গেল- বানরশিশুটি যতক্ষণ দুগ্ধদানকারী ইমেজের কাছে থাকছে তার চেয়ে অনেক বেশি সময় থাকছে স্রেফ মাতৃ ইমেজধারী স্ট্যান্ডের কাছে। দুধ বা বাস্তব পুষ্টিজাতীয় কোনোকিছু না পেলেও এখানে থাকতেই সে বেশি স্বস্তি বোধ করছে। আর আরো পরে দেখা যায়, মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এসব বানরশিশু পরবর্তীকালে হতাশা বা বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে।
এটা ছিল এমন একটা পরীক্ষা যা থেকে প্রথমবারের মতো জানা যায় যে একটি শিশুর জন্যে ভালবাসা, মমতা, সহানূভূতির মতো আবেগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এ শতাব্দীর আগ পর্যন্তও ব্যাপারগুলো ছিল অজানা। কিন্তু এখন আমরা জানি অক্সিটোসিনের কথা, যা ব্রেনে তৈরি হয় এবং মানুষের মধ্যে তৈরি করে ভালবাসা, মমতা, আকর্ষণ, যত্ন নেয়ার আবেগ।
বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, অক্সিটোসিন আছে বলেই না কি মানবসভ্যতা টিকে আছে! অবশ্য পোকামাকড়, পিঁপড়া এবং ইঁদুরের মধ্যেও অক্সিটোসিন আছে।
গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর অক্সিটোসিনের মাত্রা কমিয়ে দেখা গেছে সে ইঁদুরগুলো কম ‘সামাজিক’ হয়েছে।
তবে ভালবাসা শুধুমাত্র একটি আবেগ নয়। এটা আবেগের চেয়েও বেশি কিছু।
ক্ষুধা বা তৃষ্ণা যেমন একটা তাড়না, খিদে পেলে বা তেষ্টা পেলে যেমন সেটা না মেটানো পর্যন্ত আমরা সুস্থির হতে পারি না, ভালবাসার ক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে।
এমনকি ‘প্রেমে পাগল’ বা ‘ভালবাসায় অন্ধ’ অবস্থাগুলো স্রেফ ভাষার প্রকাশ না, বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা বাস্তব অবস্থাও বটে!
University of Pisa Italy এর মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডোনাতেলা ম্যারাযিতি ২০ জুটি প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে গবেষণা করেন। এদের ব্লাড স্যাম্পলের সাথে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওডিসি) নামক মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত রোগীদের ব্লাড স্যাম্পল মিলিয়ে দেখেন দুই দলেরই দেহে সেরোটোনিনের মাত্রা স্বাভাবিক মানুষ যারা প্রেমে পড়েনি বা মানসিক অসুস্থতায়ও আক্রান্ত নয় তাদের চেয়ে ৪০% কম।
সেরোটোনিন মস্তিষ্কের এমন এক নিউরোট্রান্সমিটার যার পরিমাণ কমে গেলে বিষণ্ণতা অবসাদ খিটখিটে মেজাজ অর্থাৎ ওডিসির মতো মানসিক রোগ দেখা দেয়।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন ‘Love the Chemical Reaction’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করে ২০০৬ সালে। প্রতিবেদনটিতে বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রেমিক-প্রেমিকা পরষ্পরকে দেখলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। এর প্রভাবে শরীর মনে সৃষ্টি হয় বাঁধভাঙা আনন্দ, অসাধারণ প্রাণশক্তি, গভীর মনোযোগ ও সীমাহীন অনুপ্রেরণা।
এজন্যে যারা সদ্য প্রেমে পড়ে তাদের মধ্যে এক ধরণের বেয়াড়া, একগুঁয়ে, দুঃসাহসী চরিত্র ফুটে ওঠে। ঘর ছাড়বে, সিংহাসন ছাড়বে, জীবন দেবে; তবু প্রেম ছাড়বে না- এমনই এক বেয়াড়াপনা দেখা যায় তাদের মধ্যে।
Evolutionary Biologist Thomas Junker এর মতে জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি স্পষ্ট যে বংশধারার সংরক্ষণ এবং তার বিকাশই প্রেমাবেগের একটা বড় কারণ।
পারস্পরিক আকর্ষণের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ বা একজন নারী অবচেতনভাবেই এমন সঙ্গীকে পছন্দ করে যে তাকে সুস্থ সবল একটি সন্তান উপহার দিতে পারবে।
যেমন, আমরা কেন কিছু মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হই- সেটা খতিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা-
প্রথমত তার চেহারা দেখে। আমরা এক মুহূর্তেই সম্ভাব্য সঙ্গীর বয়স, স্বাস্থ্য, মেজাজ এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ফেলি। নারীদের প্রতিসম মুখ, বড় চোখ, পূর্ণ ঠোঁট, উঁচু কপাল সাধারণভাবে পুরুষদের আকৃষ্ট করে। বয়সে তরুণ, সুস্থ মহিলা পুরুষের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। অপরদিকে পুরুষের দৃঢ় চিবুক, প্রশস্ত কাঁধ, সরু কোমর এবং সামাজিক অবস্থান নারীদের কাছে বিবেচ্য বিষয়।
এই বিশেষ শারীরিক গড়ন নারী-পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়াকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ সেই বংশধারা রক্ষা!
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, তীব্র প্রেমাবেগের স্থায়িত্ব খুবই কম। আজকে যাকে না পেলে বাঁচব না বলে মনে হচ্ছে, কিছু দিন পর তাকেই না ছাড়লে বাঁচবো না মনে হতেও পারে। এখন যে চেহারাটা একনজর দেখার জন্যে মন অস্থির হয়; কিছু দিন পর সেই চেহারাটাই হতে পারে সবচেয়ে অসহ্য।
মাদকাসক্তির সাথে এ অবস্থার মিল রয়েছে।
মাদকসেবী যেমন কিছু দিনের মধ্যেই নির্দিষ্ট পরিমাণ মাদকে অভ্যস্ত হয়ে যায়, আরো বেশি পরিমাণ মাদক নিতে চায়; তেমনি তীব্র প্রেমাবেগের আতিশয্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না, যদি না নতুন নতুন উদ্দীপক সংযোজিত হয়। বাস্তব জীবনে প্রতিনিয়ত নতুন উদ্দীপক আনা সম্ভব নয়। ফলে অল্পতেই ঘোলাটে হয়ে যায় প্রেমাবেগের রঙিন চশমা।
এটা যে শুধু প্রেমে পড়া কপোত-কপোতীদের ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, বিয়ের পর, তা প্রেমের হোক বা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ- মাত্র দু'বছরের মধ্যেই দেখা যায় আবেগের সেই আতিশয্য আর নেই। একটা স্বাভাবিক, দৈনন্দিন রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়িছেছে সম্পর্কটা। অনেকের এর মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটে। আর বাকিরা সম্পর্কের একটা নতুন মাত্রায় প্রবেশ করে।
গবেষক Beate Ditzen প্রেমের শারীরবৃত্তীয় প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করে বলেন, প্রেমানুভূতি সৃষ্টিকারী হরমোন অক্সিটোসিনের নিরাময় ক্ষমতাও রয়েছে, কারণ তা স্ট্রেস হরমন কর্টিসলের প্রবাহ কমায়। সুতরাং প্রেম নিরাময় সহায়ক। প্রেম মানুষের জীবনকে শুধু সুখিই করে না; স্বাস্থ্যকরও করে।
তবে তিনি এটাও বলেন, প্রেম আঘাতও করতে পারে। প্রেম হারানো বা প্রিয়জন হারানোর তীব্র আঘাত মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে। এই মানসিক আঘাত হার্ট এটাক বা হার্ট ফেইলের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন, ‘Broken Heart Syndrome’ যা কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হতে পারে।
ETH Zurich এর কার্ডিওলজিস্ট Christian Templin বলেন, ‘Broken Heart Syndrome’ একটি রোগ যেখানে তীব্র মানসিক আবেগগুলো অত্যন্ত সক্রিয় থাকে, যেমন প্রেমাবেগ। এটি প্রথমে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে হৃদয়কে আক্রান্ত করে। হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক ক্রিয়াকে বিনষ্ট করে।
কাউকে ভাল লাগা কি দোষের? না, কাউকে ভালো লাগার মধ্যে কোনো দোষ নেই। যদি বিষয়টি সীমার মধ্যে থাকে।
আমরা যাকে প্রেম বলছি, এটা আসলে নরনারীর পরস্পরের প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ। এর শুরুটা ভালো লাগা থেকে। কিন্তু সময় এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তা শুধু ভালোলাগায় সীমিত থাকে না। সৃষ্টি হয় তীব্র আবেগ ও জৈবিক আকর্ষণ। যার সুস্থ পরিণতি হচ্ছে বিয়ে ও সুন্দর পরিবার। আর অসুস্থ পরিণতি হচ্ছে আসক্তি ও অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচার। একেই তখন বলা হয় প্রেমাসক্তি বা প্রেমরোগ।
Lucy Brown বলেন, মানুষের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে বিশেষ উপাদান থাকে যা তাকে চারপাশের মানুষের দিকে খেয়াল করতে সাহায্য করে। সে প্রতিনিয়ত সামাজিক বিচারে নিযুক্ত থাকে। চারপাশের মানুষের ভালো-খারাপ, ত্রূটি-বিচ্যুতি সহজেই তার কাছে ধরা পড়ে। কিন্তু একজন প্রেমাসক্ত ব্যক্তির, যার প্রতি সে আকৃষ্ট তার ক্ষেত্রে এই বিচার-বিবেচনা ক্ষমা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
মনোবিজ্ঞানী অ্যালেন বার্শাইডও বলেন, প্রেমে পড়লে মানুষ বোধবুদ্ধিশূন্য হয়ে যায়। প্রেমিক বা প্রেমিকার সবকিছুই তখন ভালো লাগে। কোনো দোষ থাকলেও তা চোখ এড়িয়ে যায়। অন্ধ আবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ তখন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়।
এই মোহগ্রস্ততার সময় মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তন ঘটে। সেসব হরমোন তৈরি হয় তা মানুষের আচরণকে এত গভীরভাবে প্রভাবিত করে যে প্রেমানুভূতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ভালবাসা তখন সাধারণ জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে এবং ব্যক্তির আচরণ যৌক্তিক সীমাকে অতিক্রম করে উম্মাদনার প্রকাশ ঘটায়।
মাদক যে-রকম একজন মানুষের সুস্থ বোধবুদ্ধি নাশ করে ফেলে, প্রেমরোগ বা প্রেমাসক্তিও তাই করে।
তাই আমাদের প্রেমকে রোগে পরিণত না করে স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখা উচিত। ভালোলাগা ও ভালবাসার শক্তিকে সুখী পরিবার নির্মাণের কাজে লাগানো উচিত।
প্রেম নিঃসন্দেহে স্বর্গীয়। স্বর্গীয় প্রেম হচ্ছে অকাতরে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার নাম। যেমন :
দেশপ্রেম- দেশের জন্যে সবকিছু উজাড় করে দেয়ার নাম দেশপ্রেম। দেশ আমাকে কী দিল, দেশের কাছে আমি কী পেলাম তা নয়; দেশকে আমি কি দিতে পেরেছি, দেশের জন্যে কী কী করতে পেরেছি, নিজেরে দায়িত্ব সবচেয়ে ভালভাবে পালন করতে পেরেছি কিনা, এই উপলব্ধিই দেশপ্রেম।
স্রষ্টাপ্রেম- স্রষ্টার চিন্তায় বিভোর থাকা, সার্বক্ষণিক স্রষ্টার স্মরণ ও সর্বাবস্থায় স্রষ্টা সচেতন থাকার নামই স্রষ্টাপ্রেম।
মানবপ্রেম- মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করার নাম মানবপ্রেম। স্থানকাল ভেদে প্রেমের প্রকাশ ঘটে কখনো মমতায়, কখনো শ্রদ্ধায়, কখনো ভালবাসায়, কখনো সমমর্মিতায়।
আর যদি বিশ্বের কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দেয়া যায়, তবে তা হবে বিশ্বপ্রেম; আর আপনি বিশ্বপ্রেমিক।