প্রেম না জৈবিকতা?

আমরা যাকে ভালবাসা বলি, সেটা আসলে কী? প্রেম যাকে বলি, সেটাই বা কী? সাধারণভাবে একজন পুরুষ একজন নারীর প্রতি বা একজন নারী একজন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলে দুজনের মধ্যে ‘প্রেম’ হয়েছে বা ‘ভালবাসা’ হয়েছে বলতে আমরা যা বলি, তা আসলে নর বা নারী হিসেবে একজন মানুষের শারীরবৃত্তিয় কিছু কার্যকারণেরই ফল। বংশধারা রক্ষার প্রয়োজনেই মানুষকে দেয়া হয়েছে যে বৈশিষ্ট্যগুলো ।  

নিউজার্সির রাটগারস ইউনিভার্সিটির হেলেন ফিশার। প্রেমে পড়ার অবস্থাকে তিনি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথমেই যৌনাকাঙ্ক্ষা, সহজাতভাবেই একজন পুরুষ বা নারীর পরস্পরের প্রতি যা থাকে। টেস্টোস্টেরন বা এস্ট্রোজেনের মতো যৌন হরমোনের প্রভাবই এসময় মুখ্য।

প্রেমে পড়ার দ্বিতীয় ধাপ হলো আকর্ষণ। হেলেন ফিশার বলেন, এ অবস্থায় যখন একজন মানুষ পড়ে, তখন প্রেমাস্পদ ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় থাকে না। তিনধরনের নিউরোট্রান্সমিটার এসময় সক্রিয় থাকে। এড্রিনালিন, ডোপামাইন এবং সেরোটনিন।

এড্রিনালিন আসলে একটি স্ট্রেস হরমোন। এটা সেই সময়, যখন প্রেমে পড়া তরুণ বা তরুণী একজন আরেকজনকে দেখলেই হয়তো তার হার্টবিট বেড়ে যায়, হাত পায়ের তালু ঘামতে থাকে, জিহ্বা শুকিয়ে যায় ইত্যাদি।

ডোপামাইন নামের নিউরোট্রান্সমিটারটিকে প্রেমে পড়া মানুষদের ব্রেনে হেলেন ফিশার এত সক্রিয় অবস্থায়  দেখেছেন যে, কোকেনের মতো উত্তেজক মাদক নিলে মানুষ যেমন হয়, এটাও তেমনি। প্রেমিক-প্রেমিকাদের যে দেখা যায়, তাদের ক্ষিদে কমে গেছে, ঘুম হচ্ছে না বা খুব ছোট বিষয়েও অস্বাভাবিক উল্লসিত, এসব ডোপামাইনের প্রভাবেই হয়।

আর সেরেটনিন হলো সেই নিউরোট্রান্সমিটার যার ফলে প্রেমিক-প্রেমিকার চিন্তা-চেতনার পুরোটা জুড়েই থাকে কেবল একজন-আরেকজন।

আর এই অবস্থাটাকে আরো বেশি খতিয়ে দেখার আগ্রহ বোধ করলেন ইতালির একজন মনোবিজ্ঞানী  ডোনাটেল্লা মারাজ্জিতি। পিসা ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় ২০ জন এমন যুগলকে তিনি বেছে নিলেন যারা গত ছয়মাস ধরে পাগলের মতো একজন আরেকজনকে ভালবাসছে বলে মনে করছে।

মিস মারাজ্জিতির কৌতূহল ছিল, সারাক্ষণ শুধু একজনের কথাই ভাবা-র এই আচরণটা তো অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি নামের একটি মানসিক অসুখের সাথে মিলে যাচ্ছে। তার মানে কি প্রেমে পড়া আর ওসিডি-র ফলে একই ধরনের শারীরিক পরিবর্তন হয়!

মিস মারাজ্জিতির অনুমানই ঠিক হলো। আসলেই দেখা গেল প্রেমিক-প্রেমিকাদের রক্তের সেরেটনিন মাত্রা আর ওসিডি-তে ভোগা রোগীদের সেরেটনিন মাত্রা একই রকম!

তার মানে প্রেমে পড়া আসলে এক ধরনের মানসিক রোগ! অন্তত গবেষণা তাই বলে।  আর তার ফলেই হয়তো প্রত্যেক প্রেমিক যুগলই ভাবে তাদের প্রেমের সম্পর্কের চেয়ে গভীর সম্পর্ক পৃথিবীতে  আর কারো নেই!      

আর এরপরই তারা প্রবেশ করে তাদের পরবর্তী ধাপ ‘বন্ধন’, অর্থাৎ একজন আরেকজনের সাথে গাটছড়া বাধার কাজে।

এ পর্যায়ে যে হরমোনগুলোর সক্রিয়তা চোখে পড়ে তা হলো অক্সিটোসিন, ভাসোপ্রোসিন ইত্যাদি। মূলত যৌন এ হরমোনগুলোর প্রভাবেই আসলে স্বামী বা স্ত্রী একজন আরেকজনের প্রতি অনুগত হয়, অনুরক্ত হয়। মা সন্তানকে ভালবাসে বা মনের মিল না হলেও স্ত্রী স্বামীকে বা স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে যায় না।

গবেষণাগারে কিছু ভেড়া এবং ইঁদুরের দেহ থেকে সচেতনভাবে অক্সিটোসিনের মাত্রা কমিয়ে দেখা গেছে, এরা তার বাচ্চাকে আর নিজের কাছে রাখতে চাইছে না।

আবার উল্টোটাও হয়েছে। এমন কিছু স্ত্রী ইদুর, পুরুষ ইঁদুরের সাথে যাদের এখনো যৌন মিলন হয় নি, তাদের দেহে অক্সিটোসিন বাড়িয়ে দেখা গেছে, অন্য ইঁদুরের বাচ্চার প্রতি সে এমন আচরণ দেখাচ্ছে যা শুধুমাত্র একটি মা ইঁদুরই করে থাকে। 

আসলে পুরো বিষয়টাই একটা শারীরবৃত্তিয় কার্যক্রম। মহান বা মহীয়ন কিছু নয়, প্রেমের বা ভালবাসার এ বিষয়গুলো ঘটছে আসলে বংশধারা রক্ষার প্রয়োজনে। 

নিবন্ধের ইতি টানা যেতে পারে প্রেমের রসায়ন প্রসঙ্গে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কিছু মন্তব্য দিয়ে। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন,

“তুমি কি কুরূপা, দেখতে ভালো না, অসুন্দর খাটো একটা মেয়ের প্রেমে পড়বে? উল্টোভাবেও ভাবা যায়, কুদর্শন পুরুষের প্রেমে কি একটি সুন্দরী মেয়ে পড়বে?

আসলে অত্যন্ত রূপবতী কাউকে দেখলেই প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তোমার বেশি। এর অর্থ হলো, প্রকৃতি চাচ্ছে, তার সন্তান সন্ততি যেন সুন্দর হয়। এটা প্রকৃতির চাহিদা। প্রকৃতির একমাত্র লক্ষ্য এমন একটি প্রজাতি তৈরি করা, যেটি হবে অসম্ভব রূপবান, যেটি হবে অসম্ভব জ্ঞানী ও বুদ্ধিসম্পন্ন, যেটি হবে বিত্তবান।

প্রকৃতি মনে করে এই বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখার জন্যে সচল রাখার জন্যে এটা জরুরি। নিরন্তর প্রকৃতি তার এই প্রক্রিয়া সচল রেখে চলেছে।”