published : ১ অক্টোবর ২০২০
দেশে করোনা প্যানডেমিক চলছে আজ সাত মাস। করোনা সংক্রমণের সাথে মানিয়ে চলতে অভ্যস্তই হয়ে গেছে বেশিরভাগ মানুষ।
ইতোমধ্যে পরিবহন ব্যবস্থা, হোটেল-রেস্তোঁরা, অফিস-আদালত, শপিংমল-মার্কেট, বিনোদন-পর্যটনকেন্দ্র সবকিছুই খুলে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে সেই ১৬ মার্চ থেকে ।
বন্ধ থাকা এই ছয় মাসে শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জন যেমন শ্লথ হয়ে গেছে, তেমনি অনেকের তা হয়েছে পুরোপুরি বন্ধ।
কারণ ইন পারসন স্কুলিং বা শিক্ষালয়ে হাজির থেকে লেখাপড়া- কার্যকরী শেখার জন্যে এর চেয়ে ভালো বিকল্প এখনো নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থী সহায়তা সংস্থা Northwest Evaluation Association এর সমীক্ষায় দেখা গেছে-
গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় দেশটির থার্ড গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পড়ায় ২০% এবং গণিতে ২৭% অর্জন খুইয়ে ফেলে যা সে এর আগে করেছিল। নবম গ্রেডের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ৩৯% ও ৫০%।
যুক্তরাষ্ট্রে একে বলে 'সামার স্লাইড'।
গ্রীষ্মকালীন ছুটির মাত্র কয়েক সপ্তাহেই যদি শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় এরকম বিরূপ প্রভাব পড়ে তাহলে মহামারির অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই দীর্ঘ বন্ধ কতটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করেছে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে হিসাব করে দেখিয়েছেন, দৈনিক গড়ে চার শ্রেণিঘণ্টা হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাস্তরে অধ্যয়নরত প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর প্রতিদিন প্রায় ১৮ কোটি শ্রেণিঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।
তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কেবল শিক্ষাঘন্টার হিসাবে বোঝানো সম্ভব নয়। এর প্রভাব আরো দূরপ্রসারি।
আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া পরস্পর এমনভাবে সংযুক্ত, যে এক পর্যায়ে ঘাটতির প্রভাব পড়ে অন্য স্তরে।
যেমন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা প্রভাব ফেলবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়ায়। আর, মাধ্যমিকের ঘাটতির প্রভাব পড়বে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা উভয় পর্যায়েই।
'ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি)-এর গত জুনে দেশের শহরাঞ্চলের বস্তি ও গ্রাম এলাকার ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, আগে যেখানে এই শিক্ষার্থীরা স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে নিজেদের পড়ালেখায় সব মিলিয়ে দিনে ১০ ঘণ্টা ব্যয় করত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২ ঘণ্টায়!
অর্থাৎ, ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়ে সরকারিভাবে টেলিভিশনে এবং অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা করা হলেও তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে গৃহশিক্ষণ অনুষ্ঠানগুলো দেখছে এবং ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে।
অবশ্য গত তিন মাসে অনলাইন ক্লাসের প্রসার বেশ খানিকটা বেড়েছে। তবে সেটা ভালোর চেয়ে মন্দই করছে বেশি।
কারণ, একটানা অনলাইন ক্লাস বাচ্চাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়ে টানা বেলা দেড়টা, ২টা পর্যন্ত চলছে ক্লাস। এর মাঝে ১০ মিনিটের বিরতি পায় তারা।
ক্লাস শেষে স্কুল থেকে দেওয়া হোম ওয়ার্কও করতে হচ্ছে। সেই সাথে আছে অনলাইন পরীক্ষা।
ফলে একটা শিশু সপ্তাহে টানা পাঁচ দিন সাত থেকে আট ঘণ্টা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের সামনে একাকী সময় কাটাচ্ছে। স্কুলে থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, খেলাধুলার মধ্যে সময় কাটলেও এখানে তারা একা, নিঃসঙ্গ।
ফলে অনলাইনে পড়ার চাপে দিশেহারা অবস্থা শিশুদের।
কারণ, অনলাইন ক্লাসে একটি শিশু পড়া বুঝলো কি বুঝলো না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
তা-ছাড়া, স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করলে যে মনোযোগ, শিক্ষকের তত্ত্বাবধান আর সহপাঠীদের সংস্পর্শে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশলাভের সুযোগ হয় অনলাইনে সেটা অসম্ভব।
আর, দৃষ্টি, বাক বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্যেও অনলাইন পড়ালেখার সুযোগ খুব সীমিত।
বিশেষ যত্ন প্রয়োজন, যেমন- অটিস্টিক শিশু বা Attention Deficit Hyperactivity Disorder (ADHD)-এর মত শিক্ষণগত জটিলতা আছে এমন শিশু, যাদের সরাসরি শিক্ষকের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান অতি প্রয়োজন তাদের জন্যেও অনলাইন স্কুলিং কার্যকরী নয়।
আবার, দুঃস্থ-অবহেলিত যেসব পরিবারের সন্তানের জন্যে খাদ্য কর্মসূচী বা মধ্যাহ্নভোজের (মিড-ডে মিল) ব্যবস্থা শ্রেণীকক্ষে পড়ালেখায় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে তারাও কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে যদি এভাবে দিনের পর দিন স্কুলে পাঠদান বন্ধ থাকে।
এ-ধরণের শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশকে তখন জীবিকার তাগিদেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে পেশায় নিযুক্ত হতে হবে। আর এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক শিক্ষার ওপর।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অনলাইন ক্লাসের প্রভাবে শিশুরা গ্যাজেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।
কারণ, ক্লাসের সময়টুকুর বাইরেও তারা স্মার্টফোন ট্যাবলেট আইপ্যাড ল্যাপটপে বুঁদ থাকছে। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের চোখ ও মস্তিষ্ক।
সেই সাথে বাড়ছে তাদের ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও।
আসলে অনলাইন ক্লাসের পুরোটা সময় অভিভাবকদের পক্ষে শিশুর ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোরদের জন্যে।
আর, প্রি-স্কুল পর্যায়ের শিশু, যারা এখনো পুরোপুরি কথা বলতে শেখে নি- তাদের কথা বলার প্রক্রিয়াগুলোর বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই ডিভাইস আসক্তি।
অনলাইন ক্লাসে সারাক্ষণ কাছ থেকে গ্যাজেটের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় বলে তাদের চোখের দৃষ্টিও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ব্যাহত হতে পারে মানসিক বিকাশ।
এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী ডঃ মোহিত কামাল বলেন, শিশুরা যত এই ডিজিটাল দুনিয়ায় বেশি সময় ব্যয় করবে, তাদের সৃজনশীলতা ততই হ্রাস পাবে। এটি তাদের মানসিক বিকাশের পক্ষে ভালো নয়।
কাজেই করোনায় সংক্রমিত হওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও অনলাইন ক্লাসের বদলে সরাসরি স্কুলে এসে ক্লাস করাটাই শিশুদের জন্যে বেশি কল্যাণকর।
এমনটাই বলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধান মেডিকেল অ্যাডভাইজার প্রফেসর ক্রিস হুইটি।
কারণ, তার মতে স্কুলে না যাওয়ার কারণে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির শিকার হবে। বিবিসি'র ২৩ আগস্ট ২০২০-এর খবরে তার এই বক্তব্য উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর ২৩ জুলাই-এর নিবন্ধে শিক্ষার্থীদের দেহমনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার যে ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে প্রফেসর হুইটির বক্তব্যেরই প্রতিফলন দেখা যায়।
স্কুলের বাইরে শহুরে শিশুদের বাইরে বের হওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদির সুযোগ প্রায় নেই বললেই হয়।
ফলে করোনার কারণে যে দিন থেকে স্কুলগুলো বন্ধ রয়েছে সেদিন থেকে শহরের কোটি কোটি শিশুও হয়ে পড়েছে ঘরবন্দি।
ঘরে তাদের সময় কাটছে টিভি ডিশ ভার্চুয়াল ভাইরাস ও ডিজিটাল ডিভাইসে বুঁদ হয়ে। থেমে গেছে শারীরিক কর্মতৎপরতা।
ফলে শিশুদের মধ্যে মেদস্থূলতাসহ দীর্ঘমেয়াদী নানা দৈহিক জটিলতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
মেদস্থূলতার কারণে শিশুদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়; বাড়ে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুদের মধ্যে মেদস্থূলতা ২.৪ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে যদি স্কুল এ-বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
স্কুলের নিরাপদ ও সামাজিক সংহতিমূলক পরিবেশ থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত হওয়ার দরুন শিশুদের মধ্যে বিষন্নতা, আত্মহত্যাপ্রবণতা, সামাজিক উদ্বেগ ইত্যাদি নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে। সেই সাথে কমছে আত্মপ্রত্যয় ও অবসরের সদ্ব্যবহারের অভ্যাস।
৪৭৬ জন কিশোরের উপর পরিচালিত একটি নীরিক্ষাধর্মী গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।
৬ষ্ঠ থেকে ৯ম গ্রেড পর্যন্ত- এই তিন বছর তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, যাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা কম স্কুলের সাথে সংযুক্ততা তাদের জন্যে বিশেষভাবে উপকারি,
এবং এ-ধরণের কিশোরদের মধ্যে পরবর্তীতে মাদকসেবীতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে কম।
কোভিড-১৯ প্যানডেমিক অনেকের মনে যে আতঙ্ক-উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে মনোরোগবিদ্যার পরিভাষায় তা Post Traumatic Stress Disorder (PTSD)-এর একটি লক্ষণ।
ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, যুদ্ধবিগ্রহ বা সহিংসতার ঘটনায় জীবন নাশের হুমকি অনুভব করে যারা, তাদের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে এই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, কোয়ারেন্টিনে না থাকা শিশুদের চেয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকা শিশুদের মধ্যে PTSD-এর মাত্রা প্রায় ৪ গুণ বেশি!
তার মানে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকত, শিশুরা যদি নিয়মিত তাদের সহপাঠীদের সাথে, শিক্ষকদের সাথে মিলিত হতে পারত তাহলে প্যানডেমিকের প্রভাব তাদের ওপর এতটা নাও পড়তে পারত।
কারণ স্কুলের আবহে থাকলে শিশুরা কীভাবে বন্ধুত্ব করতে হয়, দলগত আচরণ রপ্ত করতে ও বজায় রাখতে হয়, পরিবারের বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে হয় তা সহজে শিখতে পারে।
আর স্কুলে যেতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই তা কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রবণতা, বখে যাওয়া, অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মত ঘটনা ঘটছে স্রেফ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।
অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, যে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে না আবার তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দেই!
আসলে কোনো শিক্ষার্থী স্কুলে গেলে যদি করোনায় আক্রান্ত হয় তাহলে যে ক্ষতি হবে এবং না গেলে শারীরিক মানসিক শিক্ষাগত- সব মিলিয়ে যে ক্ষতি হবে- তুলনামূলক বিচারে পরেরটাই অনেক অনেক বেশি।
আর এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে-সব দেশ তারা কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে।
সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জাপান, নিউজিল্যান্ডের মত উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে সেই এপ্রিল-মে মাসে।
আর মে-জুনে, মানে করোনা প্রকোপের মধ্যেই স্কুল খুলে দিয়েছে ফ্রান্স, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার মত করোনাপ্রবল দেশগুলো।
এ-ছাড়াও, ইরান ও ইতালিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে চলতি মাসে।
এমনকি করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের যে শহর- সেই উহানের সব স্কুল এবং চীনের অন্যান্য শহরের স্কুলগুলোও খুলেছে এই মাসের শুরুতে।
আর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ করোনারোগী ও অর্ধলক্ষ করোনামৃতের দেশ যুক্তরাজ্যে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর পরই অঙ্গরাজ্যগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
স্কটল্যান্ডে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগেই খুলে গেছে। আর ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে খুলেছে সম্প্রতি।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও চালু হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এই করোনাদুর্গত দেশগুলোতে সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে যে বিষয়টি বিবেচনায়- শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর কল্যাণ- সেটার নিরিখেই খুলে দেয়া উচিৎ আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের আলোকে সিডিসি বলছে- কোভিড-১৯ স্কুল বয়সী শিশুদের জন্যে তুলনামূলক কম মারাত্মক। কারণ, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম।
দুয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ১৯ বছরের কম বয়সের মাত্র ১০ জন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। যেখানে ২০ বা তার অধিক বয়সীদের মধ্যে এ-সময়ে মারা গেছে ৪৬,৭২৫ জন!
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মত করোনাদুর্গত দেশে সমস্ত করোনারোগীর মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ ১৮-র কম বয়সী শিশু-কিশোর। আর করোনায় মৃতদের মাত্র ০.১ শতাংশ হলো এই বয়সীরা।
তা-ছাড়া, গবেষণালব্ধ তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে সিডিসি বলছে- শিশুদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম।
এ-প্রসঙ্গে প্রফেসর ক্রিস হুইটির মন্তব্য-
''যুক্তরাজ্যসহ সারা বিশ্বেই এখন একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হলো- শিশুরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলেও গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে না বা তাদের খুব একটা হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না।"
তার মতে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে শিশুদের মারা যাওয়ার আশঙ্কাও অবিশ্বাস্যরকম কম! সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে যে কয়টি শিশু মারা গেছে তাদের প্রায় সবাই-ই আগে থেকেই কোনো না কোনো জটিল রোগে ভুগছিল।
সিডিসি বলছে- শিশুর স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উপর প্রভাব ফেলে- নিজের গৃহের পর স্কুলের চেয়ে ভালো আর কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না।
স্কুলে শিশুদের করোনা সংক্রমণের কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে অফিস-আদালতের মত সেখানেও সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব- বলছেন প্রফেসর হুইটি।
আর, এই ঝুঁকি-ই বা কতটা?
ইংল্যান্ডে ১০ লাখের বেশি শিশু জুন মাস থেকে প্রি-স্কুল বা স্কুলে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৭০টি শিশু!
গত আগস্টে প্রকাশিত পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের (পিএইচই) নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সেন্ট জর্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের পরিচালিত এ গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, শিশুদের স্কুলের চাইতে বাড়িতেই ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি!
এমনকি এটাও দেখা গেছে যে, পরিবারে এক বা একাধিক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হলেও শিশুদের করোনা হয়নি। শিশুদের মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে করোনা সংক্রমিত হয়েছে- এমন ঘটনাও অনেক কম।
আর, ভাইরাস ও এন্টিবডি টেস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, শিশুরা কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রধান চালিকাশক্তি নয়।
কাজেই সন্তানকে স্কুল-কলেজে পাঠানো মানে তাদের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া নয়, বরং বড় ক্ষতির মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা।
তাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যত দ্রুত খুলে দেয়া হবে তত তা আমাদের জন্যে সুদূরপ্রসারি মঙ্গল এবং কল্যাণ নিয়ে আসবে, আমরা এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব করোনা সংকট উত্তরণের পথে।