ভোজনবিলাস

শরীরটা বেশ বেতাল করে আজকাল। কম্পিউটারে বেশিক্ষণ বসে থাকলেই ঘাড় মটমট আর চোখ কটকট। পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিচ্ছি আজ ক’মাস। তবু মেরুদন্ডটা বেহাল বদমাশ। ঠিকই সিঁড়িতে উঠতে ঝিম ধরে আর বিছানায় চিৎ করে ঘুম পারে। পেটটা ছিল শত আদরের! হাত বুলিয়েছি আর ভালো খাইয়েছি। রাতে চিংড়ি আর সকালে নেহারি। আগে হজমে লাগত একটা ঢেকুড়। আজকাল হজম হতে পাড়ি দিতে হয় অনেক ঢাকঢাক-গুড়গুড়। তবু পাকস্থলিটা যে বড় প্রিয়, বলে আরেকটু মজার খেয়ে কিছুদিন অল্পই না-হয় বাঁচিয়ো?

এর মধ্যে বউ বাঁধালো বাগড়া। কোয়ান্টাম শিখে এসে আজকাল খাওয়াচ্ছে কেবল দই-চিড়া। বললুম, মতলবটা কি শুনি? গিন্নি বলে, তোমাকে আংকেল থেকে ভাই বানাতেই যত হানাহানি! রেগে আমার চক্ষু-চড়কগাছ, ছবির মতন সংসারে এ যে দেখি দুর্যোগের আভাস! হুমকি দিলাম, ধামকি দিলাম, রাতে খাওয়া বন্ধও রাখলাম। কিন্তু আজিব, বউ দেখি হাসে আর খেলে, বলে চলে, এভাবেই থাকো- কিছুদিনের জন্যে রান্নাবাড়া শিকোয় তুললাম।

কি করি ভাই বলুন তো? মাংস ভুনা আর পিঁয়াজু-বেগুনি বাদ দিয়ে কি খাবো কেবল শিং মাছের শুক্তো? এভাবে বাঁচিয়া কি উদ্দেশ্য হবে ধন্য? বউকে বলি, ভুলে গেছ কি- পৃথিবী সাহসী স্বামীদের জন্যে? আজ না খাওয়ালেও খাওয়াতে হবে কাল; যদি চাও ঘরের স্বামী ঘরেই ফেরত আসুক ভুলে বউয়ের সব ভুলভাল। বউ দেখি, হেসেই খুন! বললো, এমন বউটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল বউয়ের সেরা সে যে আমার রাঁধুনী!

ভাবলাম, হয়ে যাক তবে- এক বউ নেই তাতে কি, আরো বহুত লোক আছে বৈকি। অফিস ফেরত আনলাম ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া, কিন্তু একী! ইফতারের টেবিলে সব দেখি হাওয়া। ঝামটা মেরে বলেই ফেললাম, হচ্ছে কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি; বউও কম না, বলে কিনা, ওজন কমাও নাইলে হতেও পারে ছাড়াছাড়ি! রাগে-দুঃখে জল ছলছল চোখদুটো আমার লাল, তবে কি দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছি এতকাল?

এর মধ্যে এনে দিল এক পাঞ্জাবি, ভাবলাম ভুল বুঝে ক্ষমা চাইতেই যত কারসাজি। রাগ করে ধরলাম না, দিলাম তার চোখে ধুলা। কিন্তু গোপনে পড়তে গিয়ে দেখি বুকের বোতাম লাগলেও পেটের বোতাম খোলা। আয়নায় লাগানো চিরকুট নিশানা: “আদরের স্বামীজী, জিহ্বাকে ফেলে এইবার করো কিডনির উপাসনা”!

দিন যেয়ে রাত আসে, করলা ভাজি আর ছোট মাছের চচ্চড়ি প্লেটে চোখে কেবল বিরিয়ানি ভাসে। কলিগরা একদিন বলে, সুকুমার বাবু, দেখাচ্ছে আজকাল বেশ? ঘড়ি দেখে চমকে উঠি, অন্যদিন দুপুরে এসময়টায় ঘুম আসতো জম্পেশ। বহুদিন পর সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পেরোলাম দুটো ধাপ, এতদিন কি তবে শরীরের উপর করেছি বেজায় পাপ? ঘুম থেকে উঠে আজকাল ক্লান্ত লাগে কম, তারাবির পর হাঁটাহাঁটি করেও বহুক্ষণ তাজা থাকে মন। শখ করে সেদিন গায়ে দিলাম পুরাতন এক জামা, আয়নায় দাঁড়িয়ে বয়স কমিয়ে বাজলো আনন্দের দামামা। অবশেষে বুঝলাম বউয়ের কীর্তি, গোপনে একদিন হাত ধরে করলাম যুদ্ধবিরতি।

তরুণ ভাইদের বলি শোনো, বয়স গেলে আর আসেনা- একথা সত্য জেনো। একটু খাওয়া কমিয়ে যদি শরীরে আসে জোশ, মর্ম বুঝবে সেদিন, যেদিন ওষুধ ছাড়াই ‘দিল’ হবে খোশ। হেলায় করিয়ো না যাচ্ছেতাই খানাপিনা, আজ কষ্ট হলেও এ সাধনা বিফলে যাবে না। কবির মতন সব অভাগাই করে গুনগুন, “আকাশ তবু সুনীল থাকে, মধুর ঠেকে ভোরের আলো, মরণ এলে হঠাৎ দেখি মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো”।