আপনি কি কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন?

কালো বেড়াল দেখলেই কি আপনি ভয় পান?

ঘরের ভেতর কেউ ছাতা মেলে ধরলে কি হা হা করে ওঠেন?

ভাঙা আয়নায় মুখ দেখলে অমঙ্গল হবে, এ কথা বলে কতজনকে আপনি বারণ করেছেন?

কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, কুসংস্কারের কথা শুনে বড় হয় নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর সব দেশে সব জনপদেই আছে এমন কিছু না কিছু কুসংস্কার, যার কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা না থাকলেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ এসব বিশ্বাস করে চলেছে।

এর কিছু কিছু আবার একেবারে সব দেশে, সব সংস্কৃতিতেই প্রচলিত। যেমন, ১৩ সংখ্যা যে অশুভ, এটা মোটামুটি একটা বহুল প্রচলিত সংস্কার! কাঠে দুবার ঠকঠক করলে দুর্ভাগ্য দূর হয়ে যায়, এই বিশ্বাসও প্রায় সব সংস্কৃতিতেই চালু আছে।

প্রশ্ন হলো, এসব সংস্কারের উৎস কী? অনেকক্ষেত্রেই সংস্কারগুলো এসেছে ধর্মের নামে। যেমন, ১৩ সংখ্যার অশুভ হওয়া। লাস্ট সাপার বা শেষ নৈশভোজে যীশু খ্রিষ্টের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তার ১২ জন সহচর। আর এরপরই তিনি ধরা পড়েন এবং তাকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকেই মনে করা হয় কোনো সমাবেশে ১৩ জন থাকলে তা অশুভ। পরবর্তীতে এই ভুল ধারণা অন্যান্য বিষয়ের ওপর গিয়েও পড়ে। এমনকি ১৩ সংখ্যার প্রতি এই ভীতি কারো কারো এত মারাত্মক যে মনোবিজ্ঞানীরা রীতিমতো এর একটা নামও দিয়ে ফেলেছেন, ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া (Triskaidekaphobia)। এমনকি পৃথিবীর অনেক দেশেই বহুতল ভবনে কোনো ১৩ তলা নেই। ১২ তলার পর আপনি পাবেন ১৪ তলা।

মজার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ মানুষই কোনো প্রশ্ন না করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়ায় এসব সংস্কার বা কুসংস্কার। বড়দিনের সেই ল্যাম্ব রোস্টের গল্প তো অনেকেই জানেন। একটি মেয়ে দেখছে তার মা বড়দিন উপলক্ষে আস্ত ল্যাম্ব বা ভেড়ার রোস্ট করছে। কিন্তু ভেড়ার গলা আর নিতম্ব থেকে অনেকটা অংশ ফেলে দিয়ে। মেয়ে মাকে প্রশ্ন করছে, এতটা ফেলে দিচ্ছ কেন? মা বলছে, আমি জানি না। তোমার নানীকে জিজ্ঞেস করো। আমি তাকে এভাবেই করতে দেখতাম।

মেয়ে তখন নানীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। নানী বললেন, জানি না তো বাপু। মা-কে দেখতাম এভাবে করতে। আমিও তাই করেছি।

ঘটনাক্রমে নানীর মা মানে মেয়েটির যিনি বড় মা, তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন। মেয়েটি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মহিলাকে তার প্রশ্ন বোঝাতেই বেশ বেগ পেতে হলো। শেষমেষ বৃদ্ধা যখন বুঝতে পারলেন, তখন এক গাল হেসে তিনি যা বললেন, তা হলো এই, তিনি আর তার স্বামী মিলে তখন নতুন সংসার শুরু করেছেন। অভাবের সংসারে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ছিল না, যেমন ছিল না আস্ত ভেড়া রান্না করার কড়াই। যে কড়াইটা ছিল, তাতে ভেড়ার গলা আর নিতম্বের বেশ কিছুটা অংশ কেটে রান্না চড়াতে হতো। যতটা এখন মেয়েটির মা কাটছে, যতটা তার নানীও কেটেছে। যদিও আস্ত ল্যাম্ব রোস্ট করার মতো বড় কড়াই এখন তাদের আছে এবং আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, রান্না হচ্ছেও সেই বড় কড়াইতে। কিন্তু ল্যাম্বটাকে কেটে ফেলে!

অর্থাৎ কারণ না খুঁজেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে একটা সংস্কার। মেয়েটি যদি প্রশ্ন না করতো, তাহলে হয়তো কোনোদিনই এরা জানতো না, ভেড়া এভাবে কেটে ফেলার আসল কার্যকারণ কী।

কুসংস্কার নিয়ে অনেক বাস্তব ঘটনাও আছে। এক মা ডাব খেতেন না। কারণ তার শিশুসন্তান ডায়রিয়া হয়ে মারা যাওয়ার আগে ডাব খেতে চেয়েছিল। কিন্তু গাছের ডাব পেড়ে দেয়ার লোক না থাকায় তাকে আর ডাব খাওয়ানো যায় নি। সন্তান মারা যাওয়ার পর শোকে মুহ্যমান মা যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনোদিন তিনি ডাব খান নি।

এদিকে এই সন্তানটি মারা যাবার বহু বছর পর তিনি জন্ম দেন এক কন্যা সন্তানের। জন্মের পর থেকেই মেয়েটি দেখছে তার মা ডাব খান না। আর দেখে দেখে সে নিজের জন্যেও ডাব খাওয়াকে নিষিদ্ধ করে ফেলল। এমনকি পরবর্তী জীবনে অসুস্থ হওয়ার পর মারাত্মক পানিশূন্যতার সময়ও তাকে ডাব খাওয়াতে রাজি করানো যায় নি। অথচ এই মহিলা জানতেনও না যে তার মা কেন ডাব খেতেন না।

অর্থাৎ এই সংস্কার বা ভ্রান্ত ধারণাগুলো থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত একজন মানুষের সত্যিকারের মুক্তি সম্ভব নয়। নয় তার পক্ষে তার সম্ভাবনার প্রকৃত বিকাশ ঘটানো।

ভ্রান্তবিশ্বাস বা সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশন বা ধ্যান। মেডিটেশনের পথ ধরেই আপনি লাভ করবেন পারিপার্শ্বিক দুষ্টচক্রের শৃঙ্খল ভাঙার অন্তর্গত শক্তি। সংকীর্ণ, ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর আচরণ অভ্যাস ছিন্ন করে বপন করবেন মুক্ত আচরণ অভ্যাসের বীজ। ভয় উদ্বেগ হতাশা কাটিয়ে লাভ করবেন অভূতপূর্ব প্রশান্তি।