সততা-মানবিকতাই আকর্ষণ করবে

published : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১

একা একা ক্লাসে ১ম হওয়া যায়। কিন্তু জীবনে ১ম হওয়ার জন্যে অনেক মানুষের আনুকূল্য, সহযোগিতা, আনুগত্য লাগে। আর এটা অর্জন করার মূল শক্তি হলো সততা, মানবিকতা। কারণ মানবিকতা, নৈতিকতা, মমতা ছাড়া যত দক্ষতা, ডিগ্রি, এওয়ার্ডই অর্জন করা হোক না কেন- অর্থহীন। এমনকি প্রাচুর্যও। এই খ্যাতি প্রাচুর্য আপনাকে সম্মান দেবে না, শান্তি দেবে না, আপনাকে স্মরণীয় করবে না। মানুষ আপনাকে ভুলে যাবে বা স্মরণ করলেও বাজে উদাহরণ হিসেবে স্মরণ করবে।

একবার নবীজী (স) আলী (রা)-কে নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন কান্নার আওয়াজ। দেখলেন, একটি মেয়ে পথের পাশে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। নরম স্বরে জানতে চাইলেন কী হয়েছে তার। মেয়েটি বললো, সে একজন ক্রীতদাসী। আজ সকালে তার মনিব তাকে ৪ দিরহাম দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছিলেন কিছু কেনাকাটার জন্যে। কিন্তু পথিমধ্যে দিরহামগুলো হারিয়ে যায়। এখন সে কীভাবে বাড়ি ফিরে যাবে এ ভয়েই কাঁদছে। শুনে নবীজী (স) তাকে তার নিজের ১২ দিনার থেকে ৪ দিনার দিয়ে বললেন, বাজার থেকে সওদা কিনে চলে যেতে। নবীজী (স) চলে গেলেন।

অনেক পরে যখন আবারও এ পথ দিয়ে তিনি ফিরছিলেন দেখেন তখনও মেয়েটি খুব ভীতমুখে বসে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মা এখনও তুমি বাড়ি ফিরে যাও নি? মেয়েটি বললো, আজ আমার এত বেশি দেরি হয়ে গেছে যে, এখন যা-ই বলি না কেন মনিব বিশ্বাস করবে না। আমাকে শাস্তি প্রদান করবে। আমি তাই বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছি। জবাবে নবীজী (স) যা করলেন, মানবিকতার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।

মেয়েটিকে সাথে নিয়ে গেলেন তার মনিবের বাড়িতে। দরজা বন্ধ দেখে জোরে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। কোনো জবাব না পেয়ে আরো জোরে বললেন, আসসালামু আলাইকুম। পরপর ৩ বার বলার পর বাড়ির সবাই মিলে উত্তর দিলেন, ওয়ালাইকুম আসসালাম। নবীজী (স) জিজ্ঞেস করলেন, প্রথমবার আমি যে সালাম দিয়েছি তা তোমরা শোন নি? গৃহকর্তা বললো, ইয়া রসুলুল্লাহ্‌! শুনেছি। কিন্তু আপনার কণ্ঠ শুনতে এত ভালো লাগছিল যে, আমরা তা বার বার শুনতে চাইছিলাম।

নবীজী (স) তখন তার আসার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। গৃহকর্তা বললেন, হে আল্লাহর রসুল, শুধু এই কারণের জন্যেই কি আপনি এতদূর এসেছেন?  নবীজী (স) বললেন, হাঁ। গৃহকর্তা বললেন, এ গৃহে আপনার আগমনের শুকরিয়াস্বরূপ এই দাসীকে এ মুহূর্ত থেকে মুক্ত করে দিচ্ছি।

সততা মানবিকতার আর কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতিভূ ছিলেন তিনি। মা-বাবাকে হারিয়ে শৈশবেই হয়েছিলেন জীবনের কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। পৃথিবীর পাঠশালায় শিখতে শিখতে বেড়ে উঠেছেন স্ব-নির্ভর হয়ে। যৌবনে ধনবান স্ত্রী পেয়ে বিলাস-ব্যসনে কাটাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সব সম্পদ দান করে দিলেন দরিদ্রদের জন্যে। সত্যের বাণী প্রচার করতে গিয়ে কুরাইশদের শত বিরোধিতার মুখেও কোনো প্রতিবাদ করেন নি। শুধু নীরবে করে গেছেন নিজের কাজ। নামাজের সিজদায় যখন গিয়েছেন, ঘাড়ে উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছে বখাটে যুবকরা। ঐ অবস্থাতেই পড়েছিলেন। প্রতিশোধপরায়ণ হন নি। একসময় অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল হিজরতের সিদ্ধান্তে বাধ্য হলেন। কিন্তু সঙ্গীদের প্রতি কত সমমর্মী হলে একজন নেতা সবাইকে আগে পাঠিয়ে নিজে শেষ দলের যাত্রী হবার ঝুঁকি নিতে পারেন তা অনুমেয়। শুধু সঙ্গী নয়, তার বিরোধিতাকারী শত্রুদের যে মূল্যবান সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত ছিল তা সবাইকে ঠিকমতো বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে প্রাণপ্রিয় চাচাতো ভাই আলীকে রেখে গিয়েছিলেন মক্কায়। সঙ্ঘের শক্তিকে তিনি সংহত করেছেন তার মিশনের প্রতিষ্ঠায়। দক্ষতা আর নৈতিকতার মিশেলে তৈরি অপ্রতিরোধ্য জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করেছেন এমন এক জাতিকে শত শত বছর ধরে যারা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য আর অনগ্রসর।