অনন্য সন্তান লালনে ১০ করণীয়

published : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১

সুসন্তান স্রষ্টার এক নেয়ামত। কিন্তু সন্তান যদি অমানুষ হয়, অসুখী বা ব্যর্থ হয় তাহলে এ সন্তানই হতে পারে নরক যন্ত্রণার উৎস। আর এর প্রায় অনেকটাই নির্ভর করে আপনি আপনার সন্তানকে কীভাবে লালন করছেন তার ওপর। জেনে নিন অনন্য সন্তান পালনে ১০ করণীয়:

১. গর্ভ থেকেই শুরু করতে হবে এ লালন

গর্ভে সন্তান এলে তাকে কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত মনে করুন। পৃথিবীতে তার আগমনকে হাসিমুখে বরণ করে নিন। কারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের চিন্তা-আবেগ সবকিছুই সঞ্চারিত হয় গর্ভের সন্তানের মধ্যে। সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত হলে সে জন্ম নেবে এক গভীর অনিশ্চয়তাবোধ নিয়ে। সুস্থ-আলোকিত সন্তানের জন্যে এ সময় উৎফুল্ল থাকুন, সৎ চিন্তা করুন । আপনার অনাগত সন্তানের জন্যে মনছবি দেখুন। মেধায়-মননে-সৃজনে তাকে যেভাবে দেখতে চান ঠিক সেভাবে দেখুন। মনছবি যত নিখুঁত ও পরিপূর্ণ হবে তত বেশি তা সন্তানের মধ্যে প্রতিফলিত হবে। শিশুর জন্মের পর সুষম পুষ্টির জন্যে মা হিসেবে শিশুকে বুকের দুধ দিন। এতে আপনার সাথে তার ভালবাসার অচ্ছেদ্য বন্ধনও গড়ে উঠবে

২. মনে রাখুন আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক আপনার সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলবে

ড্রাগ এডিক্ট ও সন্ত্রাসীদের পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। একটি শিশু যখন তার বাবা-মাকে ঝগড়া করতে দেখে সে অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করে। অবচেতনভাবেই সে ভাবতে থাকে বাবা-মা’র যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাহলে আমার কী হবে? তার মধ্যে দেখা দেয় নানা মনোবৈকল্য। এমনকি আপনাদের সুসম্পর্ক কৃত্রিম না আন্তরিক সেটাও সন্তান বুঝতে পারে। সন্তান নেবার আগেই তাই ভেবে দেখুন আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্কের অবস্থানটা কী? কতটা সুস্থির? চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান কি আছে? যদি থাকে, তাহলে সেটা নিয়েও একটা সিদ্ধান্তে আসুন। সেই সাথে দুজনে মিলে ঠিক করুন সন্তানকে আপনারা কী শেখাবেন? কারণ সন্তানকে নিয়ে যদি আপনাদের মধ্যে বিতর্ক, মতানৈক্য বা কথা কাটাকাটি হয়, সেটার প্রথম শিকার হবে সন্তান নিজেই।

৩. অনেক খেলনা পোশাক বা কার্টুন নয়, আপনার সন্তানের প্রয়োজন আপনাকেই

বাবা-মায়েরা অনেক সময় সন্তানকে সময় দিতে না পারার ক্ষতিপূরণ করতে চান তাকে অনেক খেলনা, পোশাক বা কার্টুন কিনে দিয়ে। কিন্তু মনে রাখুন, এসব করে আপনি আপনার অভাব তো পূরণ করতে পারছেনই না, উল্টো তার পণ্য-চাহিদাকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সন্তানকে পর্যাপ্ত মনোযোগ না দিলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের প্রতি তার আকর্ষণ কমতে থাকবে। বিনোদন বা সময় কাটানোর জন্যে সে বেছে নেবে মোবাইল, ভিডিও গেমস, টিভি, ইন্টারনেট, পর্নোছবি বা খারাপ বন্ধুর মতো অসৎ সঙ্গকে। আর এর ফলে এমনও হতে পারে যে চিরকালের জন্যে আপনাকে আফসোস করতে হচ্ছে। তাই ঠিক করুন, প্রতিদিন আপনারা দুজনই কিছুটা সময় সন্তানের সাথে কাটাবেন। এটা যে অনেক সময় হতে হবে, তা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ সময়টা আপনারা কাটাচ্ছেন কীভাবে। সন্তানকে পাশে বসিয়ে টিভি দেখতে দেখতে আপনি যদি ভাবেন বেশ সময় দিচ্ছেন, তাহলে আপনি ভুল করবেন। দেয়ার মতো করে মাত্র ১ ঘণ্টা সময়ও যদি দিনে আপনি সন্তানকে দিতে পারেন, তাহলে সে ঐ ১ ঘণ্টা সময়ই অপেক্ষা করবে।

৪. আপনি যা বলেন সেটা নয়, আপনি যা করেন সেটাই শেখে সন্তান

আপনি যা বলেন সেটা নয়, সন্তান শেখে আপনি যা করেন সেটাই। ধরুন আপনি আপনার বুড়ো বাবা-মাকে অবহেলা করছেন। কখনো প্রত্যাশা করবেন না যে আপনার সন্তান আপনার বুড়োবয়সে খুব সেবা-যত্ন করবে। আপনি বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করবেন আর আপনার সন্তানকে বলবেন নিয়মানুসারী হতে, সেটা কখনো হবে না। কাজেই বাবা-মা হওয়ার আগে নিজেকে যাচাই করুন। সন্তানের রোল মডেল হওয়ার যোগ্যতা কি আপনি অর্জন করেছেন? আপনার কোন কোন গুণ তার মধ্যেও বিকশিত হোক এটা আপনি চান? আর কোন দোষগুলো তার মধ্যে সংক্রমিত হোক তা আপনি চান না? নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলুন। বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে যে উপদেশ পরামর্শ দেন, চেষ্টা করুন সেগুলো আগে নিজে করার। সন্তানের কাছে নিজেকে নিষ্পাপ, নির্ভুল, অভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরবেন না। কারণ কখনো যদি আপনার ভুল প্রকাশিত হয়ে পড়ে তখন সে বিভ্রান্ত হবে। ভুল করে ফেললে অকপটে দুঃখ প্রকাশ করুন। এতে আপনার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধাবোধ যেমন বাড়বে তেমনি আপনিও তার মডেল হতে পারবেন।

৫. সন্তানকে না বলতে শিখুন

আপনি যদি আপনার সন্তানকে কোনোকিছু চাওয়ামাত্র পাওয়ায় অভ্যস্ত করে তোলেন, সে কখনো ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা বা পরিশ্রমের গুরুত্ব বুঝবে না। সন্তানের প্রতিটি চাওয়াই পূরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি দেয়ার আগেও তাকে কিছুটা অপেক্ষায় অভ্যস্ত হতে দিন। এতে তার মধ্যে ধৈর্য এবং সহনশীলতার গুণাবলি গড়ে উঠবে। সে বুঝবে পেতে হলে কষ্ট করতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়। আর সব চাওয়াই কল্যাণকর না-ও হতে পারে। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য ও বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দিন। আর্থিক ব্যাপারে ভুল ধারণা দেবেন না। আসলে সন্তানের সাথে প্রয়োজনে দৃঢ় হতে দ্বিধা করবেন না। আপনার দৃঢ়তা তার নিরাপত্তাবোধকেই বাড়াবে।

৬. সন্তানকে লালন করুন আদর ও শাসনের সমন্বয়ে

সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্যে আদর ও শাসন দুটোরই প্রয়োজন আছে। অধিকাংশ বাবা-মায়েরা এখানেই ভুল করেন। ছোটবেলা অতিরিক্ত আহ্লাদ দেন। কিন্তু একটু বড় হয়ে যখন বখে যেতে শুরু করে, তখন শাসন করতে যান। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই সন্তানের বয়স যদি ৩ বছর হয়ে যায় তাহলে তখন থেকেই কোনো অন্যায় করলে তাকে বোঝাতে শুরু করুন। ভুল করে ফেললে তার মাশুল পেতে দিন। প্রয়োজনে শাস্তি দিন। তখন পরিণতি থেকে সে শিক্ষা নিতে পারবে। সন্তানের বদভ্যাসকে অঙ্কুরে বিনাশ করুন। তবে মারবেন না এবং অন্যের সামনে বকবেন না বা ভুল ধরিয়ে অপ্রস্তুত করবেন না। আড়ালে সংশোধন করে শুধরে নিতে দিন। তবে মনে রাখুন, শুধু শাসন করে সন্তান মানুষ করা যায় না। তার মেধার বিকাশে আপনার স্নেহ, মমতা ও সমমর্মিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। যে-কোনো ভালো কাজে সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করুন।কাজে সংযুক্ত না রাখলে খেয়ালীপনায় সে তার সময় নষ্ট করবে।

৭. ননীর পুতুল না বানিয়ে সন্তানকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী হতে শেখান

বাবা-মায়েদের একটা প্রবণতা হলো বাস্তবজগতের সকল বৈরিতা, বিপদ আপদ থেকে সন্তানকে আগলে বড় করতে চান তারা। তারা চান ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ যেন শুধু লেখাপড়া নিয়েই থাকে। আর এর ফলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে বাস্তবজ্ঞানবর্জিত জীবন-জগৎ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একটা আবহে। যারা পরিশ্রম করতে জানে না। বোঝে না বইয়ের বাইরের কোনোকিছুই। আপনার সন্তানকে তাই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমে অভ্যস্ত করে তুলুন। একটু একটু করে দায়িত্ব দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী করে তুলুন। তার কাজ যতটা সম্ভব তাকেই করতে উদ্বুদ্ধ করুন।

৮. সন্তানকে দিতে শেখান

যে দিতে জানে সে-ই জানে ভালোভাবে বাঁচতে। শিশুকাল থেকেই আপনার সন্তানের মধ্যে দাতার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দেয়ার আনন্দের স্বাদ তাকে পেতে দিন। যেমন, আপনার পরিবারে হয়তো কাউকে কোনো গিফট দেবেন। গিফটটি আপনার সন্তানের হাত দিয়ে দেয়ান। এতে তার মধ্যে দাতার অভ্যাস গড়ে উঠবে।

৯. ধৈর্য ধরুন

সন্তানের মধ্যে রাতারাতি ভালো গুণাবলি দেখতে চাইবেন না। ধৈর্য ধরে পরিবর্তনের জন্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন। তা নইলে আপনি হতাশায় ভুগবেন। আপনি হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া করে ফেলতে পারেন, যা সন্তানের জন্যে আরো বিপজ্জনক হবে।

১০. সন্তানের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করুন

সন্তানের প্রতি আসক্ত হবেন না। সে আপনার সম্পত্তি নয়, আপনার কাছে স্রষ্টার আমানত। তাকে যথাযথ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নৈতিকগুণে গুণাণ্বিত করে অনন্য মানুষরূপে গড়ে তোলা পর্যন্তই আপনার দায়িত্ব। আর সন্তানের প্রতি আপনার কর্তব্য পালনের জন্যে প্রতিদানের আশা করবেন না। বার্ধক্যে তাকেই আশ্রয়স্থল হিসেবে ভাববেন না। স্রষ্টাই প্রকৃত আশ্রয়দাতা।