published : ১২ ডিসেম্বর ২০১৭
মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনো এক স্কুলছাত্র। তার গল্পটা আগে বলে নিই।
কী একটা উপলক্ষে ওদের ক্লাসে একদিন বেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। সবারই পানির তেষ্টা পেয়েছে। তাই কয়েকটা গ্লাস জোগাড় করে দপ্তরিকে বলা হলো টিউবওয়েল থেকে জগভর্তি করে পানি এনে দিতে। ক্লাস-ক্যাপ্টেন সেই ছেলেটি নিল সবাইকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্ব।
মিনিট বিশেক ধরে চলল এই পানি-পান পর্ব। দপ্তরি জগভর্তি করে পানি এনে দিচ্ছে, ছেলেটি সেই জগ হাতে সহপাঠীদের কাছে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছে। সবার খাওয়া শেষ হলে ছেলেটি গিয়ে বসে পড়ল তার বেঞ্চিতে।
আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা অতি সামান্যই।
কিন্তু একটু পরেই হঠাৎ যে অপার্থিব শিহরণ ছেলেটি অনুভব করল, সেটি তার জীবনে এই প্রথম। জীবনে প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করল-চাইলে সে-ও অন্যের জন্যে কিছু করতে পারে! ক্লাসে প্রথম হয়ে কিংবা ক্লাস-ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় সবার স্নেহ ও সমীহ জোটে বটে, কিন্তু তার চেয়েও এক অলৌকিক আনন্দ আর সুখ মেলে পরার্থে কিছু করতে পারায়। এই সুখানুভূতির তোড়ে নিজের ছোটখাটো খেদ-দুঃখ রাগ-অভিমান কোথায় যে মিলিয়ে যায়!
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছেলেটি সেদিন বুঝতে পেরেছিল-জগতে তারও একটা ভূমিকা আছে, তারও কিছু দেয়ার আছে পৃথিবীকে।
প্রিয় পাঠক, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। কথাটা সাধারণত বলা হয়ে থাকে তাচ্ছিল্য অর্থে, কিন্তু সেই দিন বুঝি এবার ফুরাল!
সাম্প্রতিককালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী-মনোবিদদের চমকপ্রদ সব গবেষণা-প্রতিবেদনগুলো বলছে, ঘরের খেয়ে সত্যিই যারা বনের মোষ তাড়াতে পারেন অর্থাৎ কোনোরকম প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই চারপাশের মানুষ ও সমাজের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করে যান, তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ে ক্রমশ। কমে হতাশা-বিষণ্ণতা-একাকিত্বের অনুভূতি। তাদের পেশাজীবনেও সৃষ্টি হয় অনবদ্য সাফল্য-সম্ভাবনা।
এ প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ- এখন থেকে চিকিৎসকদের উচিত সুস্থতার জন্যে রোগীদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণে কাজ করার পরামর্শ দেয়া।
পেশাগত দায়িত্ব বা কোনো ব্যাপারে কি উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন? স্ট্রেস কি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আপনার দৈনন্দিন জীবনে? নাকি বিষণ্ণতার আক্রমণে আপনি পর্যুদস্ত? ভয় নেই। আছে মোক্ষম সমাধান।
বাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন, আপনার পাশেই কি দাঁড়িয়ে আছেন গর্ভবতী নারী বা বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ? আপনার আসনটা তার জন্যে ছেড়ে দিন। অধস্তন ব্যক্তিটি নিত্যদিন আপনাকে আগে সালাম দেন, আজ কি উল্টোটা হতে পারে না?
দিনশেষে ভেতরে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আপনি নিজেই টের পাবেন। এই যে অন্যের তরে সাধ্যমতো কিছু করলেন, একটুখানি দিলেন, ওই ‘দেয়া’টুকুতেই সুখ, তাতেই জীবনের অর্থপূর্ণতা। কারণ একটু একটু করেই একসময় মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে বড় কিছু দিতে। সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে।
সাইকোলজি টুডে সাময়িকীর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যের কল্যাণে কাজ করে যে নির্মল সুখানুভূতি আমরা লাভ করি, তাতে সেরোটনিন-এন্ডোরফিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার ও হরমোনের প্রবাহ বাড়ে, যা বিষণ্ণতা-দুশ্চিন্তার মতো নেতিবাচক আবেগের ঝুঁকি কমায়। সেইসাথে বাড়ায় রোগ প্রতিরোধ শক্তি। সংহত হয় আবেগীয় ভারসাম্য। দেহ-মনকে করে চনমনে ও গতিময়।
উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ স্ট্রেস। আর মানবকল্যাণে কাজ স্ট্রেস কমায় বলে এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় এর সত্যতা মিলেছে। তাতে দেখা গেছে, বছরে অন্তত দুশ ঘণ্টা স্বেচ্ছাশ্রমে ব্যয় করেছেন এমন স্বেচ্ছাসেবীর রক্তচাপ আগের তুলনায় কমেছে।
এতে নেতৃত্বদানকারী গবেষক রোড্লশিয়া স্নিড বলেন, এসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশের পর শুধু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যেই এখন অনেকে সেবামূলক কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
স্বেচ্ছাশ্রমে কেবল বয়স্করাই উপকৃত হচ্ছেন না। সম্প্রতি কানাডায় ১০ম গ্রেডে পড়ুয়া ১৬০ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ও অতিরিক্ত ওজন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।
গত কয়েক দশকে বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা বা আলঝেইমার্স রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে সারা পৃথিবীজুড়েই। এটি প্রতিরোধের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা গুরুত্বপূর্ণ বটে, তার পাশাপাশি সেবামূলক কাজে সময় দেয়ার মাধ্যমেও আপনি এ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদেরই পরামর্শ এটি।
বার্ধক্যবিষয়ক চিকিৎসা-সাময়িকী জার্নাল অব জেরোন্টোলজি-তে গবেষকরা বলেছেন, সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডের ফলে মানব মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতায় ঘটে ইতিবাচক পরিবর্তন। আন্তঃনিউরোন সংযোগ বাড়ে মস্তিষ্কে। কমে আলঝেইমার্সের ঝুঁকি। ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের ক্ষেত্রে এভাবেই বার্ধক্যজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আছে আরো চমকপ্রদ তথ্য। সেবাধর্মে নিবেদিত একদল বয়োবৃদ্ধ নান-এর মৃত্যুর পর তাদের মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখেন, এক-তৃতীয়াংশের মস্তিষ্কই ছিল আলঝেইমার্সের উপসর্গ-আক্রান্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৈনন্দিন কাজকর্ম যেমন : শিশুদের পড়ানো, জটিল ধাঁধা সমাধান এমনকি গাড়ি চালিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে দেয়ার কাজেও ওরা ছিলেন দারুণ স্বচ্ছন্দ।
এর কার্যকারণ ব্যাখ্যায় গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্ক মানবদেহের এমন একটি বিস্ময়কর অঙ্গ-যার কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো হলেও সে ঠিকই তার অক্ষত অংশটুকু দিয়ে কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নিতে সক্ষম-যদি সে ব্যক্তির সামনে থাকে নিত্যনতুন কর্মচাঞ্চল্য, চ্যালেঞ্জ ও কর্মপরিকল্পনা।
আর এ ধরনের কাজের সুবাদে পরিচিতির গন্ডিটা বড় হয় বলে গড়ে ওঠে একটা সত্যিকারের সামাজিক যোগাযোগ এবং নতুন নতুন সম্পর্কের উষ্ণতায় মানুষ ক্রমান্বয়ে মুক্তি পায় পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের মতো (অতীত কোনো তিক্ত স্মৃতি বা দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট) বিভিন্ন মনোদৈহিক ও স্নায়বিক জটিলতা থেকে।
২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের ‘রয়াল ভলান্টারি সার্ভিস’ পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সঙ্ঘবদ্ধ সেবাকার্যে উৎসাহী মানুষেরা পরিণত বয়সে বিষণ্ণতা ও সামাজিক একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন। তুলনামূলকভাবে এরা হন তৃপ্ত ও প্রশান্ত। সেবাব্রতী মানুষদের জীবনমানেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করেছেন গবেষকরা।
সামাজিক কল্যাণে বিভিন্ন সেবা-কার্যক্রমে যারা সময় ও শ্রম দেন, তারা হন অধিকতর আত্মবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে সক্ষম। নানা কাজের অভিজ্ঞতায় উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলোও তারা সামলে নিতে শেখেন দ্রুততর দক্ষতায়। গবেষকরা বলছেন, এটি পেশাগত সমৃদ্ধিতেও রাখে দারুণ ভূমিকা।
শৈশবে এমন কাজের সুযোগ-পরিবেশ ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যে উচ্চতর মূল্যবোধ গড়ে দেয়। এ কারণেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা আছে এমন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
তাই আসুন, সাধ্যমতো আমরাও নিবেদিত হই সৃষ্টির সেবায়, মানুষের কল্যাণে। পরার্থপরতার মধ্য দিয়েই খুঁজে নিই জীবনের সার্থকতা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সেবা-উদ্যোগগুলো আরো গতিশীল হয়ে উঠুক আমাদের আন্তরিক শ্রম, সময় ও অর্থে। আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ সেবা-প্রচেষ্টায় আলোকিত হোক লক্ষ দুস্থ-বঞ্চিতের জীবন।