ভাড়াটে বন্ধু !

ঘটনা-১

খুব একা লাগছে আপনার! প্রিয় কোনো মানুষের সাথে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আপনার কোনো প্রিয়জন নেই। নেই কোনো পরিজন বা বন্ধু। আর থাকলেও ব্যস্ততার কারণে বা বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। তখন কী করবেন আপনি?

আপনি যদি জাপানে থাকেন, তাহলে এরকম অবস্থায় ঘণ্টায় ২৫ ডলারে আপনি একজন পুরুষ বা নারীকে ভাড়া করতে পারবেন, যে বন্ধুর মতো আপনার কথা শুনবে, আপনার সাথে গল্প করবে, সেলফি তুলবে, ডিনারে সঙ্গ দেবে। তারপর সময় শেষ হওয়া মাত্র পেমেন্ট নিয়ে বিদায় হবে। অবশ্য যাওয়ার আগে বলে যাবে যে, আপনি চাইলে আবারো তাকে ভাড়া করতে পারেন।

অবিশ্বাস্য শোনালেও নিঃসঙ্গ আর বিচ্ছিন্ন জাপানী জনজীবনে এখন এটাই বাস্তবতা! টোকিও শহরে এমন বেশ কিছু এজেন্সি গড়ে উঠেছে যারা অর্থের বিনিময়ে ক্লায়েন্টকে বন্ধু (!) সাপ্লাই করে। ভাড়াটে এই বন্ধুদের কাজ হলো ক্লায়েন্টের সাথে গল্প করা, বেড়াতে যাওয়া বা স্রেফ তার কথা শোনা, তাকে ভরসা দেয়া যেমনটি বন্ধুরা একে অপরের সাথে করে থাকে!

ম্যাকি আবে এমনই এক এজেন্সির মালিক। আট বছর ধরে তিনি এই এজেন্সি চালাচ্ছেন। এখন দেশজুড়ে তার ১৬টি শাখা, স্টাফসংখ্যা ৩০০। ম্যাকি আবে বলছিলেন, অর্থের জন্যে তিনি এই এজেন্সি খোলেন নি। জাপানীদের অর্থের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তাদের মনে শান্তি নেই। তাদের মনের শান্তির জন্যে, নিঃসঙ্গতা ঘোচাবার জন্যে তিনি শুরু করেছেন এ ব্যবসা। মজার ব্যাপার হলো, বন্ধুর পাশাপাশি দাদী-নানীও ভাড়া দেয় ম্যাকি আবের এজেন্সি!

ঘটনা-২

মার্কিন মুলুকে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়তে যাওয়া একজন বাংলাদেশি ছাত্র। দ্বিতীয় বর্ষের সময় রোগী কীভাবে দেখতে হয়, সে-রকম কিছু পরীক্ষা দিতে হলো তাকে। তো রোগী দেখার সায়েন্টিফিক পার্টটাতে বেশ ভালো করলেও হিউম্যানিস্টিক পার্টগুলোতে সে খুব কম নাম্বার পেল। কারণ হিসেবে তাকে জানানো হলো, রোগীর কথা শোনার সময় সে নাকি সিমপ্যাথেটিক (!) ছিল না। ছাত্রটি জানতে চাইল, সেটা কী করে বোঝা গেল? বলা হলো, রোগীর কথা শোনার সময় তুমি দুঃখী দুঃখী চেহারা করেছিলে ঠিকই, কিন্তু মুখে তেমন কিছু বলো নি।

পরবর্তীতে যখন সে মুখেও অনেক রকম সমবেদনার কথা তার রোগীদের বলতে লাগলো, তখন রোগীরা তাকে এত বেশি বেশি নাম্বার দিতে লাগল যে, স্বয়ং ডিরেক্টর তাকে ডেকে পাঠালেন যে, সামান্য সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট হয়ে রোগীদের কাছ থেকে এত নাম্বার সে কীভাবে পাচ্ছে সেটা বোঝার জন্যে!

প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের এ দুটি উদাহরণের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দুটি ক্ষেত্রেই যে মিলটি পাওয়া যাচ্ছে, তাহলো পণ্যের পেছনে, বাহ্যিক চাকচিক্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে এই মানুষগুলো যখন একাকিত্বে আক্রান্ত হয়েছে, তখন সমমর্মিতার প্রয়োজন হয়েছে তাদের। কিন্তু পরিবারের কাছে বা প্রিয়জনের কাছে তা না পেয়ে তারা ছুটেছে এজেন্সির ভাড়াটে বন্ধুর কাছে কিংবা ডাক্তারের কাছে! এমনকি মেডিকেল স্কুলের শিক্ষার্থীদের ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবেও তারা রেখেছে এই empathetic হবার পার্টকে; যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে শিখতে হচ্ছে রোগীর কথা শুনে কী করে দুঃখী দুঃখী চেহারা করতে হবে তাকে। অথবা কী কী কথা বললে রোগী আশ্বস্ত হবে যে, হাঁ, এই ডাক্তার আমার প্রতি সমমর্মী ছিল!

আসলে সমমর্মিতা মানুষের এমন একটি প্রয়োজন যা ছাড়া তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা হতে হবে নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত। যেখানে দেয়া-নেয়ার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আর এটা আসবে ধর্মের মূল্যবোধকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে পারলে। কারণ একমাত্র ধর্মই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রকৃত সমমর্মিতায় উজ্জীবিত হতে। সেটা শুধু মানুষের প্রতি নয়, সেটা পশুর প্রতি, বৃক্ষের প্রতি, এমনকি প্রকৃতির প্রতি।

একবার নবীজী (স) অজু করছিলেন। অজু করতে করতেই দেখলেন, পাশ দিয়ে একটি বিড়াল হেঁটে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত চোখে বার বার তাকাচ্ছে তার দিকে। দেখেই নবীজী (স) বুঝলেন, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বেড়ালটি কাতর হয়ে পড়েছে। সাথে সাথে অজু থামিয়ে পানিভর্তি পাত্রটা তিনি বাড়িয়ে দিলেন বেড়ালের দিকে এবং আকণ্ঠ পানি পান করে পুরোপুরি তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকলেন। এরপর বেড়ালটি চলে গেলে নবীজী (স) আবার অজু করতে লাগলেন।

মহামতি বুদ্ধের অনুসারী দুই ভিক্ষু একবার ঝিরিতে থালাবাটি ধুচ্ছিলেন। হঠাৎ একজন দেখলেন, একটা বৃশ্চিক পানিতে ডুবে গিয়ে ভেসে যাচ্ছে। তিনি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে আটকে বৃশ্চিকটাকে পানি থেকে তুলে তাকে একটা পাথরের ওপর রাখলেন। কিন্তু এটা করার সময় বিছাটা তার হাতে একটা কামড় বসিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ পর থালাবাটি ধুতে ধুতে ভিক্ষু আবারো দেখেন, বিছাটা কীভাবে যেন আবারো পানিতে পড়েছে, হাবুডুবু খাচ্ছে। আবারো তিনি ওটাকে তুললেন। এবারো বিছাটা কামড়ে দিল তার হাতে।

দূর থেকে এসব দেখছিলেন তার সঙ্গী ভিক্ষু। তিনি মন্তব্য করলেন, দেখেছ, বার বার বিছাটা কামড়ে দিচ্ছে তোমাকে, তারপরও ওটাকে তুলতেই হবে! জান না, কামড়ে দেয়াই ওর স্বভাব!

সাহায্যকারী ভিক্ষু তখন মন্তব্য করলেন, ঠিকই বলেছ বন্ধু। কামড়ে দেয়া ওর স্বভাবই বটে। কিন্তু আমার স্বভাব যে ওকে বাঁচানো! সেটা না করে আমি থাকব কীভাবে!