বিস্ময়কর সব্জি-রাজ্য

‘মানবস্বাস্থ্যের জন্যে এবং পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে নিরামিষাশী হওয়ার থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না।’ কালজয়ী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা এটি। বলেছিলেন তা-ও প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীর দর্শন-চেতনায় খাবারদাবার ঢুকে পড়ার রহস্যটাই-বা কী? বোধ করি, একবিংশ শতাব্দীর ভুল খাদ্যাভ্যাসজনিত স্বাস্থ্য-দুর্যোগ তিনি কিছুটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ফলমূল ও সব্জির পুষ্টিগুণের উপযোগিতা সম্পর্কিত তথ্যের বাস্তব প্রয়োগ তাদের জীবনে ঘটাতে পারছেন না, ফলে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষের ওজন এখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।

এ অবস্থার প্রেক্ষিতে পুষ্টিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ হলো, প্রচুর শাক-সব্জি ও ফলমূল খান। বেছে নিন প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারের তুলনায় তাজা খাবার। আর যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন ‘রেড মিট’ বা গরু খাসি মহিষ ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর মাংস।

তবে শুধু শাক-সব্জি ফলমূল খেলেই হবে না, কোন ফল বা সব্জি খেতে হবে বা কতটুকু খাব সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, একটি কলায় মোট ১২০ ক্যালরি আছে, যা দুটো রুটির মোট ক্যালরির সমপরিমাণ। পেঁপে পেয়ারা কামরাঙা আমলকিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ, বি ও সি এবং সেইসাথে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম।

ঢেঁড়সে আছে প্রচুর আঁশ, যা হজমে সহায়ক। মরিচে আছে ভিটামিন সি। গাজর ও অন্যান্য হলুদ সব্জি যেমন মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে ভিটামিন এ, যা চুলের কোষের পূর্ণতা আনে আর ত্বক ও চোখ ভালো রাখে। কাঁচা পেঁপে হজমে সহায়ক এবং এসিডিটি নিয়ন্ত্রণে তুলনাহীন। এতে আছে ভিটামিন এ, সি ও বি কমপ্লেক্স, এমাইনো এসিড, ক্যালসিয়াম ও আয়রন। এতে আরো আছে এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। আর সবুজ শাক হলো প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, আঁশ এবং মিনারেলের উৎস।

দেহকোষের ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে রোগের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধ করে চলা এই ফুড-সোলজারগুলো ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

এই যে এত সব পুষ্টি, অতিরিক্ত তাপে রান্না করলে বা বেশি সেদ্ধ করলে অবশ্য সবই পণ্ড। কারণ, সব ধরনের শাক-সব্জিতেই রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু এনজাইম বা পাচক রস, যা হজমে সহায়তা করে। কিন্তু কোনো সব্জি পুরোপুরি বা অতিরিক্ত সেদ্ধ করলে সেই বিশেষ এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই শাক-সব্জি যতটা সম্ভব কম সেদ্ধ করুন, পারলে আধা সেদ্ধ করে খাওয়ার অভ্যাস করুন। এ-ছাড়াও সব্জি ধুয়ে নিতে হবে কাটার আগে। কাটতে হবে বড় বড় টুকরো করে। আর খোসার সাথে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন। যেমন, আলুর খোসায় রয়েছে ভিটামিন বি, সি, পটাশিয়াম, আয়রন ও জিংক। ফুলকপির সবুজ পাতাগুলোয় রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, আঁশ ও বিটা ক্যারোটিন। সুতরাং খোসা বা আবরণ এবং পাতাসহ সব্জি রান্না আপনার খাবারে যোগ করে বাড়তি পুষ্টি। আর অবশ্যই খাবারে তেল-মশলা এড়িয়ে চলুন, যতটা সম্ভব।

সমীক্ষায় দেখা যায়, ভুল খাদ্যাভ্যাস শতকরা ৮০ ভাগ হৃদরোগ ও ৯০ ভাগ ডায়াবেটিসের জন্যে দায়ী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ফল ও শাক-সব্জির প্রাচুর্য রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল কমাতে ওষুধের মতো একইরকম কার্যকরী। খাদ্যাভ্যাসে আঁশযুক্ত খাবার যোগ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার বর্জন টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এর সপক্ষে প্রমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

সবমিলিয়ে বলা যায়, আমাদের ‘সব্জি রাজ্য’ স্রষ্টার এমন অপূর্ব সব নেয়ামতে পরিপূর্ণ, যা দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে যথেষ্ট। পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে বাঁধাকপি, বরবটি এমনকি ধনেপাতা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। প্রকৃতির এমন সব অসাধারণ উপহারগুলো অবহেলা করবেন না। চেষ্টা করুন ঘুরেফিরে সব ধরনের শাক-সব্জি খাওয়ার। পুষ্টি থাকবে অটুট।

ইংরেজ নাট্যকার ও লেখক জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, ‘খাদ্যের প্রতি যে প্রেম, এর চেয়ে বিশ্বস্ত প্রেম আর হয় না’। বটে। কিন্তু ওটা ‘বিশ্বস্ত’ থাকে কেবল তখনই, প্রেমটা যখন হয় শাক-সব্জি ফলমূলসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি। সে প্রেম আপনাকে দেবে সুস্থতা ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক আনন্দময় দীর্ঘজীবন।