‘ভাষার জীবনমরণ’ প্রসঙ্গে

published : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪

বিচারপতি এম এ মতিন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আপীল বিভাগের প্রাক্তন সর্বজ্যেষ্ঠ বিচারক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ভিজিটিং প্রফেসর।

 

[২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে ‘ভাষার জীবনমরণ’ শিরোনামে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, লেখক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকারের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেই লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ নিবন্ধটি প্রকাশ করা হলো।]

 

কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকারের ‘ভাষার জীবনমরণ’ শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধটি পড়লাম। বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। প্রবন্ধটি পাঠ করার পর আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় যে ভাষাটির জীবনমরণ সমন্ধে ভাবিত হলাম তা হলো—সিলেটি ভাষা। ভাষা স্রষ্টার অন্যতম আয়াত। আয়াত বলতে আমরা বুঝি নির্দশন বা প্রতীক। মহান স্রষ্টা তাঁর সর্বশেষ নাজিল করা কিতাব আল কোরআনে ঘোষণা করছেন—

‘পরম দয়াময় আল্লাহ। তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে (গুছিয়ে চিন্তা করতে ও) স্পষ্টভাবে কথা বলতে শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান : ১-৪)

কোরআনের প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী সূরা আর-রাহমান-এর ৪ নম্বর আয়াতটির অনুবাদ করেছেন এভাবে : ‘He has taught him an intelligent speech.’

সৌদি আরবের ইফতা কর্তৃক সম্পাদিত ইংরেজি অনুবাদে ‘কথা বলা বা বয়ান’ শব্দের তর্জমা করা হয়েছে—An intelligent speech. The Holy Quran, English translation of the meaning and commentary-র ৫১৭৩ নম্বর নোটে বলা হচ্ছে—বয়ানের অর্থ Power of expression—capacity to understand clearly the relations of things and to explain them. সৃষ্টিজগতে একমাত্র মানুষ ছাড়া কথা বলার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয় নি। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে :

‘হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারো।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)

বিশ্বমানবের একে অন্যের কাছে পরিচিত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে এই বয়ান বা ভাষা। হয়তো আপনি একই বিমানে যাচ্ছেন, পাশে বসা ইউরোপীয় দম্পতি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু আপনি তাদের কথার বিন্দু-বিসর্গ বুঝতে পারছেন না। পরস্পরকে অজানা রেখে দিচ্ছে পারস্পরিক ভাষা না জানার প্রাচীর। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোষণা করছেন :

‘জীবনে জীবন যোগ করা

না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।’

ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, জাতিতে জাতিতে মিলনের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে এই ভাষা না জানার অভিশাপ। বলা হয় আমাদের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোস্তফা আলী ১৭টি ভাষা জানতেন। অনুরূপ সংখ্যার ভাষা মওলানা আবুল কালামও জানতেন। তাই দেখা যাচ্ছে, সভ্য জগতে প্রচলিত সব কয়টি ভাষা একজনের পক্ষে জানা সম্ভব।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার ভাষার জীবনমরণের এক অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন। কী করে সংস্কৃতের মৃত্যু হলো, কী করে সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন হওয়া বিভিন্ন উপভাষা স্থান করে নিল। ইউরোপে ল্যাটিনকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল, তার কারণ এবং প্রক্রিয়া এমন প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করা নিঃসন্দেহে মুন্সিয়ানার দাবি রাখে। তার লেখা পড়ে আমি সিলেটি ভাষার ‘জীবনমরণ’ সমন্ধে ভাবিত হলাম।

কী করে ভাষার মৃত্যু ঘটে তা বলতে গিয়ে ড. পবিত্র সরকার বলেছেন :

‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বক্তারা দিব্যি বেঁচে থাকে, কিন্তু তারা নিজেদের এতদিনকার নিজস্ব ভাষাটা বলা (বা লিখিত ভাষা হলে লেখা) ছেড়ে দেয়। বলা উচিত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, অর্থাৎ প্রতিবেশের রাজনীতি-শিক্ষানীতি-অর্থনীতি তাদের বাধ্য করে ভাষাটা ছেড়ে দিতে। নিজেদের ভাষা ছেড়ে তারা অন্যদের ভাষা বলতে শুরু করে। একে বলে ‘ভাষালম্ফন’, ইংরেজিতে কারো কারো কথায় language shift। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাষার মৃত্যু ঘটে ওই ভাষালম্ফন বা আরো স্পষ্ট কথায় ভাষাবর্জনের ফলে।’

সিলেটি ভাষা : ফিরে দেখা

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সুদূর ইয়েমেন থেকে আসা এক মহাপুরুষ বাংলাদেশের বর্তমান সিলেটে তার পবিত্র পা রাখলেন। তার নাম শাহজালাল মুজাররদে ইয়েমেনি। ইয়েমেনে জন্ম নেয়া এই মহাপুরুষ মাত্র ৩২ বছর বয়সে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসেন। গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দেন। সিলেট বিজয়ের পর পবিত্র ধর্ম ইসলামের বাণী জনগণের মধ্যে প্রচারের মাধ্যম খুঁজতে লাগলেন। কিছু সংখ্যক ভাষাবিদদের নিয়ে সিলেটি ভাষার বর্ণমালা আবিষ্কার করলেন। যার নাম হলো ‘সিলেটি নাগরী’। একে আবার ভুল করে বলা হয় ‘দেব নাগরী’।

এ ভাষায় ইসলামের মৌলিক শিক্ষামূলক বই-পুস্তক লিখিত হলো। শুধু তা-ই নয়, এক সমৃদ্ধ পুঁথিসাহিত্যের ভাণ্ডার রচিত হলো। সিলেটের ঘরে ঘরে মানুষ মুন্সী সাদেক আলী রচিত ‘কেতাব হালতুননবী’ গ্রন্থটি সিলেটি ভাষায় পড়ার সুযোগ পেল। সুদূর পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসি রচিত ‘শাহনামা’ সিলেটি ভাষায় পড়ার অপূর্ব সুযোগ হয়ে গেল। ছেলেবেলায় আমিও মহাকাব্য ‘শাহনামার’ অমর কাহিনী সিলেটি ভাষাতেই পুঁথিপাঠ শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। রুস্তম কীভাবে পারস্যের সীমান্ত রক্ষায় জীবনের শেষ দিনটি উৎসর্গ করেছিলেন, নিজের অজান্তে আপন সন্তান সোহরাবকে শত্রুজ্ঞানে হত্যা করেছিলেন, তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা কতই না কেঁদেছি! সিলেট জেলা, আসামের কাছাড় জেলা এবং আশপাশের মহকুমাগুলিতে আজও সিলেটি ভাষা মানুষের মুখের ভাষা। এ ভাষায় অমর কবি শীতালং শাহ রচিত ‘শুয়া উড়িল উড়িল/ জীবেরও জীবন, শুয়া উড়িলরে/’ হুমায়ুন আহমেদের কল্যাণে আজ সারা বাংলার সম্পদ। শাহ আব্দুল করিমের সব কয়টি গান সিলেটি ভাষায় রচিত।

পরিতাপের বিষয় সেই আমিও এখন ‘কেতাব হালাতুননবী’ পড়তে পারি না। আমার মতো অসংখ্য সিলেটিভাষী এই বর্ণমালাকে বর্জন করে বসে আছি। এ ভাষার লিখিত কোনো চর্চা এখন আর নেই। অথচ মায়ের ভাষার অধিকার একটি মানবিক অধিকার; যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারে স্বীকৃত। সিলেটবাসী বা সিলেটি ভাষাভাষী সকল শিশুর জন্মগত অধিকার হচ্ছে এ ভাষায় শিক্ষা লাভ করা। দুঃখের বিষয় এটা এখন দুরাশা।

অথচ এই সিলেটেই শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত মনিপুরী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সিলেটের জৈন্তাপুরে গারোদের মধ্যে বাংলা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ বিতরণ করা হয়। ২০১১ সালে আমার শিলং ভ্রমণের সময় শিলং-এর হাইকোর্ট বেঞ্চের বাঙালি রেজিস্ট্রার আমাকে জানিয়েছিলেন—১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শিলং-এ খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৭ জন এবং ২০১১ সালে ঐ সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল শতকরা ৬৬ জন। খাসিয়া এবং অন্যান্য আদিবাসীরা তাদের মাতৃভাষায় প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পারছে। বাংলাদেশে অসংখ্য জাতিসত্ত্বা তেমন কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। অথচ আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষালাভ করা শুধু সিলেটিদের নয়; বরং প্রত্যেক বাংলাদেশির জন্মগত অধিকার। উল্লেখ্য, মনিপুরী তথা গারোদের ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে সকল চেষ্টা কিন্তু ব্যক্তিগত চেষ্টায় সীমাবদ্ধ।

বিশ্বের প্রায় ২ কোটি মানুষের মুখের ভাষা সিলেটি। লন্ডনের সিলেটি রিসার্চ এন্ড ট্রান্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে মোট ৪২টি ভাষা প্রচলিত আছে। সর্বাধিক কথিত ১০০ ভাষার তালিকায় ১ কোটি ১৮ লাখ ভাষাভাষী নিয়ে সিলেটির অবস্থান ৯৭ তম।

রিসার্চ এন্ড ট্রান্সলেশন সেন্টারের সংখ্যাটি সঠিক নয় বলে কেউ কেউ জোর দাবি করেন। তাদের মতে, এ সংখ্যা ২ কোটি অতিক্রম করেছে। সিলেটের জনসংখ্যা অনেক আগেই ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সিলেটি ভাষার প্রচলন ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে এখনো দৃশ্যমান।

ভাষা গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতে জটিল সংস্কৃত-প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে ‘সিলটি নাগরী’ লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।

বিশ্বে কথ্যভাষার সংখ্যা ৭৩৫৮টি। ২০০৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৮০৯। ভাষা নিয়ে গবেষণা এবং অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান ইথনোলগ-এর সর্বশেষ প্রকাশনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী তার ‘আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা : উত্তরাধিকার ও মুসলিম নাগরী’ গ্রন্থে যথার্থ বলেছেন—

‘সিলেটি নাগরী বা মুসলমান নাগরী আসলে দেব নাগরী ও বাংলা বর্ণমালার প্যারালাল হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল। শাহজালাল (র)-এর সঙ্গী ৩৬০ জন সুফীর মধ্যে অনেকেই কাইথী ভাষা এবং বর্ণমালার সাথে পরিচিত ছিলেন। তাই সিলেটি নাগরী লিপি উদ্ভাবনে তাদের অবদানও থাকতেই পারে।’

তিনি লেখেন—

‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কারণে বিশেষত দেব নাগরীর বিপরীতে সিলেটি নাগরীকে মুসলমানী নাগরী বলা যেতে পারে। মধ্যযুগে আরকান রাজ সলিম শাহ (১৫৯৩-১৬১২) তার মুদ্রায় ঐ নাগরীর ব্যবহার করে সিলেটি নাগরীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।’

তার মতে, যোগেশ চন্দ্র ঘোষ ও অধ্যাপক শিব প্রসন্ন লাহিড়ীর তথাকথিত ‘মত’ অর্থাৎ—

‘বিজেতা মুসলমানেরা (খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে) সিলেটে প্রচলিত দেব নাগরী গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে যা সিলেটি নাগরী নামে চিহ্নিত হয়—এটা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন। তার মতে, স্যার গিয়ারসনও দেব নাগরীকেই সিলেটি নাগরী বলে তুলে ধরেছেন।’

তার মতে,

‘দেব নাগরী জাত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্তিলাভের লক্ষ্যেই মুসলমানী লিপির উদ্ভব ঘটে। সাথে সাথে মুসলমানী কথ্যবুলিও চালু হয়। এটি ছিল মুসলমানদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জনের যুগান্তকারী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।’

২৮ জুন ২০১৭ বাংলা ট্রিবিউন পত্রিকায় একটি নিবন্ধে বলা হয় :

‘নাগরী লিপির সাহিত্য ধারণ করেছে সিলেটি ভাষা। চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকে বাংলা ভাষার সতন্ত্র এ লিপি উদ্ভবের পর থেকেই রচিত হয়েছে দু’শতাধিক গ্রন্থ, বিভিন্ন সাহিত্য ও গান। দলিল-দস্তাবেজ তৈরিসহ ওই সময়ের দৈনন্দিন কাজ চলেছে নাগরি লিপি ব্যবহার করেই। সময়ের বিবর্তনে এ লিপি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে এই লিপিটি যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য ২০০৮ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন সিলেটের সন্তান এবং উৎস প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা সেলিম। ২০১৪ সালে ২৫ খণ্ডে নাগরী লিপির বই প্রকাশিত হয় এ প্রকাশনী থেকে।’

মোস্তফা সেলিমকে অবশ্যই সিলেটি নাগরী রক্ষায় প্রথমসারির ভাষাপ্রেমিক বলা যেতে পারে। তাকে আমাদের অভিবাদন।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার হিব্রু ভাষার পুনরুজ্জীবনের ইতিহাস বিবৃত করে লিখেছেন :

‘যে ভাষাগুলি মৃতপ্রায় বা মরণোন্মুখ, সেগুলির পুনরুজ্জীবন (revitalization) কি সম্ভব? আবার বলি, সেটাও নির্ভর করে ভাষার নতুন করে অর্জন করা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির উপর। সেই সঙ্গে গোষ্ঠীর ব্যাকুল আবেগ ও ইচ্ছার উপর। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইজরায়েলের হিব্রু ভাষা। ইজরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দুহাজার বছরের কিছু আগেই লুপ্ত হয়েছিল, ইহুদিরা পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সেই সেই দেশের ভাষা গ্রহণ করেছিল—এ ঘটনা ভাষার মৃত্যুর ধ্রুপদি ছক অনুযায়ীই ঘটেছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শক্তিদের কৃপায় ১৯৪৮-এ প্যালেস্টাইনিদের জমি অধিগ্রহণ করে নতুন ইজরায়েলের পত্তন হওয়ার পরে পৃথিবীর মধ্যে জ্ঞানে বিত্তে ও অন্যান্য অর্জনে (ইহুদিদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে আটশো জনের বেশি) বিপুলভাবে সমৃদ্ধ প্রচুর ইহুদি ফিরে এসে ইজরায়েলে স্থায়ী আবাস নির্মাণ করে। ইংরেজি, জার্মান, ইডিশ (এটি জার্মানের একটি উপভাষা), ফরাসি, রুশ ইত্যাদি ভাষী ইহুদি মানুষেরা এই নতুন রাষ্ট্রের পত্তন করে যখন একটি গোষ্ঠীভাষার প্রয়োজন বোধ করল, তখন তারা কোনো একটি উপস্থিত গোষ্ঠীর অভ্যস্ত ভাষা গ্রহণ করল না, বরং নিজেদের প্রাচীন ভাষা, যা তাদের ধর্মগ্রন্থে (ওল্ড টেস্টামেন্ট, তালমুদ ইত্যাদি), ধর্মাচরণে ব্যবহৃত, সেই প্রাচীন হিব্রুকেই নতুন করে মুখের ভাষা হিসেবে বাঁচিয়ে তুলল। পৃথিবীতে এ রকম দৃষ্টান্ত আর নেই।’

ইজরায়েলিরা মৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করে একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। ২ কোটি মানুষের ভাষা সিলেটি এখন কথ্যভাষা হিসেবেই বেঁচে আছে। বর্তমান প্রজন্ম শেষ হয়ে গেলে সিলেটি ভাষা কথ্যভাষা হিসেবেও আর বেঁচে থাকবে না। লিখিত সিলেটি ভাষা ইতোমধ্যে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। মোস্তফা সেলিমের মতো ভাষাপ্রেমিক নাগরিকরাই ইজরায়েলের উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে সিলেটি ভাষাকে লিখিত ভাষায় পুনরুজ্জীবন দান করতে পারে। সিলেটি নাগরী বা মুসলমানী নাগরী লিপি এখনো হারিয়ে যায় নি। তাই সম্মলিত চেষ্টায় এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে এই সিলেটি নাগরী-কে লিখিত শিক্ষার বাহনরূপে স্বীকৃতি দান করার এখনই সময়।’