বিসর্জন

আমাদের মালিবাগের বাসায় বছরে উৎসব ছিল তিনটা। আমাদের দুই ঈদ আর কাকুদের দুর্গাপূজা। ছোটকাকু ছিলেন আমাদের পাঁচ ভাই-বোনের সমস্ত আবদারের উৎস। সবাই মিলে আব্বার কাছে মার খেতাম আর দোতলায় ছোটকাকুর কাছে আশ্রয় পেতাম। কাকীমা ছিলেন কাকুর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট; আমার মার চেয়েও। তাই মাকে মনে পড়ে কাকীমাকে সেলাই শেখাতে, কুমড়ার বড়া বানানো দেখাতে। ঝগড়া করতে দেখি নি কখনও। বরং কাকীমার বিচারে মার কাছে ছোটকাকুর বকা খাওয়ার ঘটনা প্রচুর।

আব্বা আর কাকু ছিলেন সহকর্মী। হাউস-বিল্ডিং ফাইন্যান্সের লোন নিয়ে করা আব্বার আর ছোটকাকুর সেই তিনতলার বাসায় ঈদ আর পূজা আসত বিশাল ধুমধামে। ঈদের আগের রাতে কাকু আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে যেতেন চুল কাটাতে। আর কাকীমা বোনদের নিয়ে বসতেন হাতে মেহেদী লাগাতে। ঈদের দিন আব্বার পরে প্রথম কোলাকুলি করতাম কাকুর সাথে। পূজায় আব্বা যেতেন ছোটভাইকে নিয়ে বিসর্জনের মেলায়। সবার ছোট আদরের ভাইটা পূজার দিন বেড়াতে আসা নিজের আত্মীয়দের সাথে থাকতে চাইত না মোটেও। অবশ্য কে যে ‘নিজের আত্মীয়’, আর কে পর—তা বুঝেছি অনেক পরে। কাকুকে কখনও দেখি নি তার নিজের দুই সন্তানের চেয়ে আমাদের তিন ভাইবোনকে আলাদা করে দেখতে। উৎসব-পার্বনে জামা আসত সবার জন্যেই। মায়ের হাতের মাংস রান্না খুব পছন্দ ছিল কাকুর—তাই কতদিন যে নাস্তা করেছেন আব্বার সাথে আমাদের নিচতলার বাসায়! আমরাও কোনোদিন হিসেব করি নি কে কার খেলনা নিয়ে খেলছে, আর কার ঘরে শুচ্ছে।

ছোটভাইয়ের সাথে ভাব ছিল খুব। তাই টিচারের কাছে যতবার মার খেয়েছি—বাসায় উদ্ভট কাহিনী বলে আব্বার হাত থেকে সে-ই বাঁচিয়েছে। লক্ষী ছেলে আমার ছোটভাই–আব্বার মাথা টিপে দিত বলে, স্কুলে মারামারি করত না বলে, চুলে একপাশ সিঁথি করত বলে—আব্বা আমাকে শাসাতেন, ভাইকে জ্বালালে উনি আমাকে বের করে দিবেন! আমার বয়েই যেত! ছোটকাকু আছেন না! আব্বা সাথে না রাখলেই কী!

মাধ্যমিকে বড়বোন স্টার পেল। সবাই সে কি খুশি! আব্বা ছিলেন সিলেট–তার আসতে আরো দেরি। ছোটকাকু মিষ্টি দিয়ে পাড়া মাথায় করে ফেললেন। ছোড়দিকে বললেন, লেখাপড়া না করলে বড়বোনের বাসায় ঝি-গিরি করতে হবে। ছোটবোন আর ছোড়দি ভীষণ জ্বলল; বলল, বড়দি দেখতে খারাপ তাই পড়ালেখায় ভালো। এরপর কীভাবে যেন ছোটবোনও তিনটা লেটার পেয়ে গেল। কাকীমা পনেরশ টাকা খরচ করে একটা শাড়ি দিলেন। আমি পাশ করলাম টেনেটুনে।

তখন দিন পাল্টেছে। পাড়ায় আর মিষ্টি দেয়া হয় না। আমাদের বাসায় টাইলস বসেছে, কাকুদের বাসায় নতুন টিভি। কেউ কারো বাসায় আসে না। কাকু খবর পেলেন টেলিফোনে। বললেন, ‘একদিন আসিস, কিছু নিয়ে যাস্’। ছোড়দির রেজাল্টের খবর কেউ পেল না। আমার সুন্দরী ছোড়দি, রিক্সায় গেলে সবাই তাকিয়ে থাকত; অথচ নিজের বাড়ির নিচতলার কেউ জানল না সে প্রথম বিভাগ পেয়েছে। বোনেরা মিলে একদিন অনেক লুকিয়ে ছোড়দিকে বাইরে খাওয়াল। একা ছেলে হিসেবে আমার কাজ ছিল পাহারা দেয়ার। সেদিন এক আনন্দের সময়, তবু কেন জানি সবার মন ছিল খারাপ। দামী দশ-টাকার পরাটার স্বাদ কারো মুখে জোটে নি। আসার আগে বড়বোন কাঁদলেন–ওর বিয়ে যে ঠিকঠাক। ছোড়দিও কাঁদল। আমাকে ধরে। হু-হু করে। আমি কাঁদি নি। উচ্চ-মাধ্যমিকের ছেলে কি কাঁদে? যে বোর্ডিং স্কুলে নিজের ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় পায় না—তার কি কান্না করা মানায়?

আমাদের মালিবাগের বাসা এখন ১২ তলা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। আট তলায় আব্বা-আম্মা আর আমি। কাকু-কাকীমা বনশ্রী। বোনেরা যার যার বাসায়। ছোট ভাইটা অস্ট্রেলিয়া থেকে এল গেল সপ্তাহ। আজকাল দেখা-সাক্ষাত নেই বললেই চলে। কখনও যদি কথা ওঠে–নাস্তার টেবিলে বা ছুটি প্রসঙ্গে, আমি সন্তর্পনে এড়িয়ে যাই। পূজা তো এখন স্রেফ একটা ছুটির দিন। কীসের টান! কীসের স্মৃতি! ভাবি, আমার ভাইটাও বোধ হয় এভাবেই পালিয়ে বেড়ায় ঈদের আলোচনা। সে হয়তো তার দুর্বল বড় ভাইয়ের উপর রাগ করে, অভিমানে কটূক্তি করে। করবেই তো, যে ভাইকে টিচারের মার থেকে বাঁচাল—সে ভাই কেন হাল ছেড়ে দিল? কেন বড়দের জেদের মুখে আলাদা হতে দিল? বাবাদের কী নিয়ে মন কষাকষি; আজ অবধি আমরা জানি না। শুনেছি বহুবার—আমরা দুষতে শিখেছি কাকুকে, ভাইরা দুষেছে আব্বাকে। ঝগড়া কি ছিল চাকরি নিয়ে? হয়তো কোনো এককালে। সেখান থেকে ঝগড়া হয়েছে ধর্ম নিয়ে। ঝগড়া হয়েছে কে কার সন্তানকে ভুল শিখিয়েছে তা নিয়ে। এতসব যুক্তিতর্কের মাঝখান দিয়ে আমাদের পরিবারটা গেল ভেঙে।

বড়বোনের বিয়েতে কাকুদের দাওয়াতও দেয়া হয় নি। সেই কাকুকে–যার কাঁধে চড়ে বড়বোন বড় হয়েছিল। আম্মা কাঁদতে পেরেছিলেন, আব্বার বিরুদ্ধে গিয়ে হাত ধরে কাকীমাকে আনতে পারেন নি। কাকু প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ছোটভাইকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে। জানতেন, আব্বার চোখের মণিকে দূরে সরিয়ে দিলে আঘাত ফেরত দেয়া যাবে। জেদ। আর জেদ। সবকিছু ধ্বংস করার জেদ। সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক—ক্ষমা চাওয়া যাবে না।

এত্তগুলো বছর পেরিয়ে আজ আমার মনে হয়—একবার সামনে দাঁড়াই। কাকু-কাকীমার পায়ে ধরে মাফ চাই। বলি, আব্বার রাগ আমাদের উপর ঝেড় না। ছোট ভাইটাকে বলি, ভুল হয়ে গেছে। আব্বার-আম্মার-আমাদের সবার। ক্ষমা কর, আবার ঈদের দিন দেখা কর, পূজায় এসে জোর করে আমার মানিব্যাগ উজাড় করে টাকা নিয়ে যা। আব্বাকে দেখে যা। আমার আব্বাকে—যিনি এখনও জানতে চান তোর খবর, তোর রেজাল্ট। আর আমাকে বলেন তার পেসমেকারের অপারেশনটা অস্ট্রেলিয়াতে করা যায় কি না! সেই মহাদেশে গেলে হয়ত তোকে কাছে পাওয়া হবে।

বড়বোনের বাসায় সবার দাওয়াত। সবাই আয়। বড়বোন-ছোড়দি-ছোটবোন-আমি-তুই-আব্বা-কাকু-কাকীমা-আম্মা। সময় খুব কম। আব্বা প্রায়ই ভুলে যান নাম-চেহারা। ভুলে গেলেই ভালো। আবার নতুন করে শুরু করি। কাকুর কাশীতে যাওয়ার আগে, আম্মার হিপ-রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির আগে, ছোটবোনের ছেলেটা স্কুলে যাওয়ার আগে, ছোটভাইটা আবার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে—একদিন সবাই মিলি, রাগ করি, ঝগড়া করি, অন্তত কথা বলি। পরিবারটাকে আবার মেরামত করি। বহু বছর পর ঈদ আর পূজা একসাথে এসেছে। চল্‌, আমরাও একসাথে হই।